Home » অগাস্ট কোঁৎ কে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন?

অগাস্ট কোঁৎ কে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন?

by Rezaul Karim
অগাস্ট কোঁৎ কে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন

সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অগাস্ট কোঁৎ

অগাস্ট কোঁৎ কে সমাজবিজ্ঞানের জনক কেন বলা হয় তার উত্তর সংক্ষেপে না দিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে এই উত্তরটি খুঁজবো। আলোচনাটি নিম্নরূপ-

ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী সময়ের মানুষ হিসেবে অগাস্ট কোঁৎ তাঁর কৈশোর এবং যৌবনে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা এবং বিপর্যয় অবলোকন করেন। ফরাসি বিপ্লবের ফলে সামন্তবাদীদের অবসান ঘটে। পূর্বের শ্রেণিবৈষম্যজনিত সমাজকাঠামো কিছুটা বিলুপ্ত হয় বটে; কিন্তু সরকার ও প্রশাসনের ভার অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের উপর অর্পিত হওয়ার ফলে সামাজিক পরিস্থিতির মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে। যার পরিণতিতে সমাজে নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় ।

ফরাসি বিপ্লবোত্তর সমাজের স্থিতিশীলতা ও সংহতি ফিরিয়ে আনার প্রয়াস হিসেবে অগাস্ট কোঁৎ সমাজবিজ্ঞান নামক একটি পৃথক বিজ্ঞানের কথা উল্লেখ করেন এবং সমাজবিজ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি প্রথমে এই বিজ্ঞানকে ‘সোশ্যাল ফিজিক্স’ (Social Physics) নামকরণ করেন। পরবর্তীকালে এর নামকরণ করা হয় ‘সমাজবিজ্ঞান’ (Sociology)। এই কারণেও অগাস্ট কোঁৎ কে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।

এছাড়াও অগাস্ট কোঁৎ সমাজবিজ্ঞানকে পদার্থবিদ্যার অনুসরণে মানবসমাজের স্থিতিশীলতার বিষয়কে সোশ্যাল স্ট্যাটিক্স (Social Statics) এবং সমাজের গতিশীলতার বিষয়কে সোশ্যাল ডায়নামিক্‌স (Social Dynamics) এ দু’ভাগে বিভক্ত করেন। সমাজকাঠামো এবং সমাজকাঠামোর স্থিতি ও ঐক্যের অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান হলো সোশ্যাল স্ট্যাটিকস-এর আলোচ্যবিষয়। অপরদিকে, সমাজের পরিবর্তন ও প্রগতির সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয়াদির অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান হলো ‘সোশ্যাল ডায়নামিক্স’ এর বিষয়বস্তু। এ প্রসঙ্গে তিনি সমাজের স্থিতিশীল (Static) এবং গতিশীল (Dynamic) বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন। শৃঙ্খলা বলতে সমাজের স্থিতিশীল এবং প্রগতি বলতে সমাজের গতিশীল দিককে বুঝায়।

আরও পড়ুন:   অগাস্ট কোঁৎ এর পরিচয় এবং তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ সমূহ

অগাস্ট কোঁতের মতে, সামাজিক স্থিতিশীলতা সমাজের গঠন এবং কাঠামোর সাথে সম্পৃক্ত। অপরদিকে, সামাজিক গতিশীলতা বা চলমানতা মানবসমাজের প্রগতি এবং উন্নতির বিশ্লেষণ করে। তাঁর মতে, সব সমাজেই এ দু’টি লক্ষণ দেখা যাবে। কারণ যুগপৎ সমাজ স্থিতিশীল ও গতিশীল। স্থিতিশীলতা বলতে অচল, অনড় অবস্থা বুঝায় না; স্থিতিশীলতা বলতে সুশৃঙ্খল সমাজ বুঝায়। সুশৃঙ্খল সমাজে পরিবর্তন ঘটে নানা কারণে। তবে ধারাবাহিকতা নষ্ট করে দিয়ে নয়, বরং ধারাবাহিকতার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। কোঁৎ সুশৃঙ্খল সমাজের পরিবর্তনকে গতিশীলতা বলেছেন।

পরিবর্তনশীল জগতে কী কী কারণে সমাজের গতিশীলতা ত্বরান্বিত বা বিলম্বিত হয় এ বিষয়টির বিশ্লেষণের উপরও তিনি আলোকপাত করেছেন। তাঁর মতে, একদল দার্শনিক সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার উপর অধিক গুরুত্বারোপ করেন। এঁরা রক্ষণশীল ধারণার প্রবক্তা। এ শ্রেণির চিন্তাবিদরা সামাজিক প্রগতি ও গতিশীলতার বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করেন। আবার দার্শনিকদের মধ্যে বিপরীতক্রমে সামাজিক প্রগতি ও সমাজের গতিশীলতার উপর অধিক জোর দিতে গিয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার বিষয়টিকে অবহেলা করেন। কিন্তু কোৎ এর মতে, এ দু’য়ের মধ্যে কোনরকম স্ববিরোধ নেই। তাঁর মতে, সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার সাথে সামাজিক প্রগতি ও গতিশীলতার সংযোগ সাধন সম্ভব এবং উভয়ের সহাবস্থান একান্তভাবে অপরিহার্য। শৃঙ্খলার সাথে সংহতি বজায় রেখে স্থিতিশীল সমাজকে গতিশীল করা যায় এবং এভাবে শৃঙ্খলার সাথে প্রগতির সামঞ্জস্য সাধন সম্ভবপর হয়। তিনি মনে করেন, সুসংগঠিত ও সুসংহত মানবসমাজের স্বার্থে শৃঙ্খলা এবং প্রগতি উভয়ই অপরিহার্য। প্রগতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “Progress is the development of order.” অর্থাৎ, নিয়ম-শৃঙ্খলার উন্নয়নই হচ্ছে প্রগতি। তাই তিনি মনে করেন, নিয়ম- শৃঙ্খলার উন্নতি হলেই সে সমাজ প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে। প্রগতি সম্বন্ধে কোঁতের ধারণা হলো এই যে, বস্তুগত উন্নতির চাইতে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার থেকে মানুষের মুক্তি ও তার মধ্যে সামাজিকতাবোধের বেশি প্রয়োজন। প্রগতি মূলত শৃঙ্খলা; স্থিতিশীলতার অর্থে ব্যবহৃত হয়। সামাজিক স্থিতিশীলতা সম্ভব। কেননা মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক উন্নতিতে সক্ষম, একমাত্র মানুষই ভালোবাসার দ্বারা চালিত হয়। উন্নতি বলতে ধর্মীয় চেতনা বিকাশ ও অহংবোধের উপর বিশ্বপ্রেমের স্থান পাওয়াকে বুঝায়। সামাজিক উন্নতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে- এটি চলমান। এ চিন্তার প্রেক্ষাপটে তিনি সমাজের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের যোগসূত্র ক্রমান্বয়ে উন্নতির বিবর্তন হিসেবে দেখিয়েছেন।

অগাস্ট কোঁৎ সমাজকে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের যোগসূত্র হিসেবে কতকগুলো বাস্তব পদ্ধতি অনুশীলনের উপর গুরুত্বারোপ করেন। বিমূর্ত নীতি (Abstract principle) বা অনুমাননির্ভর তত্ত্বের (Speculative theories) পরিবর্তে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করে সামাজিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করার প্রতি তিনি গুরুত্ব দেন। এ অনুশীলনের ভিত্তি হচ্ছে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও তুলনামূলক পর্যালোচনা। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা এবং গুরুত্ব সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই সমাজ সম্পর্কিত বিষয়সমূহের স্বরূপ নির্ণয় করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একদিকে তাঁর পদ্ধতি বিজ্ঞানে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির যেমন পরিচয় মেলে তেমনি আবার তাঁর দৃষ্টবাদী বিবর্তনবাদ রক্ষণশীল চিন্তাধারা হিসেবে অভিহিত। 

অতএব উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, সমাজবিজ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণসহ সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগাস্ট কোঁতের ভূমিকা অসীম। এজন্যই অগাস্ট কোঁৎ কে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।

Related Posts