Home » ইতিহাসতত্ত্ব কি? – আলোচনা কর

ইতিহাসতত্ত্ব কি? – আলোচনা কর

by Rezaul Karim
ইতিহাসতত্ত্ব কি

ইতিহাসতত্ত্ব

মানুষ, তার সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের প্রামাণ্য ও লিখিত দলিল। হল ইতিহাস। এ ইতিহাস সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তি হলেন ঐতিহাসিক। আর ইতিহাস বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ব্যক্তি হলেন ইতিহাস দার্শনিক। অতএব বলা যায়, ইতিহাসের উৎস সম্পর্কে জানা, ইতিহাসের কার্যকারণ বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করা, ইতিহাস লেখার যথাযথ পদ্ধতি করায়ত্তকরণ, ঐতিহাসিক ও ইতিহাস দার্শনিকদের সম্পর্কে যথাযথভাবে জ্ঞান অর্জন করা, নিবিড়ভাবে ইতিহাস অনুশীলন, ইতিহাসবোধ ও উপলব্ধি এবং এতদসংক্রান্ত রীতিনীতিকে সাধারণভাবে ইতিহাসতত্ত্ব (Historiography) বলে অভিহিত করা যায়।

আবার অন্যভাবে বলা যায়, ইতিহাস শব্দের উৎপত্তি ও এর যথাযথ অর্থ সম্পর্কে জানা, ইতিহাস বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, ইতিহাসকে সংজ্ঞায়িত করার যথাযথ রীতি ও কৌশল সম্পর্কে অবহিত হওয়া, ইতিহাসের সঠিক বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিতকরণ, এর বিষয়বস্তু ও পরিধি সম্পর্কে স্পষ্টীকরণ, ইতিহাসের উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সম্যকভাবে জ্ঞান লাভ করা এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন হল ইতিহাসতত্ত্ব।

ইতিহাসতত্ত্ব বলতে ইতিহাসের সকল প্রকার বৈশিষ্ট্য ও শাখা-প্রশাখা সম্পর্কিত জ্ঞানের পাশাপাশি ঐতিহাসিক ও ইতিহাস দার্শনিকদের অত্যাবশ্যকীয় গুণাগুণ, মতাদর্শ ও কর্মপদ্ধতিসহ তাদের এতদসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়কেও বুঝানো হয় ।

ইতিহাসতত্ত্বের মধ্যে ইতিহাস সংশ্লিষ্ট উৎস, তথ্য ও বিবরণও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস একান্তভাবেই উৎস ও তথ্য নির্ভর। কাজেই এ উৎস ও তথ্য সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান এবং উৎস ও তথ্য হতে সঠিক বিবরণ বের করার কৌশল করায়ত্তকরণও ইতিহাসতত্ত্বের অঙ্গীভূত বিষয়। প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনার যথাযথ প্রেক্ষিত সম্পর্কিত জ্ঞান, প্রতিটি ঐতিহাসিক বিষয়ের লক্ষ, উদ্দেশ্য, কারণ, ফলাফল ও তাৎপর্য সম্পর্কিত জ্ঞান ইতিহাসতত্ত্ব এবং ইতিহাসের আলোকে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও ইতিহাসতত্ত্বের গণ্ডিভুক্ত বিষয়।

তাহলে দেখা যায়, ইতিহাসতত্ত্ব বলতে আমরা ব্যাপক অর্থে ইতিহাস সম্পর্কিত সকল প্রকার অনুশীলন এবং ইতিহাস সম্পর্কে একজন ঐতিহাসিক ও ইতিহাস দার্শনিকের মেধা, মননশীলতা ও যাবতীয় কার্যক্রমকে বুঝে থাকি। ইতিহাসের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ সম্পর্কে কোন্ ঐতিহাসিক কোন্ ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছেন এবং বাস্তব জীবনের সাথে ইতিহাসের সামঞ্জস্য বিধানের যৌক্তিকতা কতটুকু তা নির্ণয় করাও ইতিহাসতত্ত্বের পরিধিভুক্ত বিষয়।

সমাজের উদ্ভব, বিকাশ, চরমোৎকর্ষ, ক্রমবিবর্তন, সমাজ সম্পর্কিত পঠনপাঠন, অনুশীলন এবং বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীদের জীবনী, কার্যক্রম ও উক্তিকে কেন্দ্র করে যেমন সমাজতত্ত্ব গড়ে ওঠে, তেমনি ইতিহাস শব্দের উদ্ভব, এ শব্দের যথাযথ ব্যবহার, এর আভিধানিক অর্থ, মর্মগত অর্থ, বিশ্লেষণাত্মক অর্থ, প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগে ইতিহাস সম্পর্কিত পঠন-পাঠন, ইতিহাস লিখন পদ্ধতি, ইতিহাস সম্পর্কিত যাবতীয় জ্ঞান ও কার্যক্রম এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও ইতিহাস দার্শনিকদের জীবনী, ইতিহাস সম্পর্কিত তাদের সকল প্রকার কর্ম, মানুষ, সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে তাদের যাবতীয় বক্তব্য, তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ইতিহাসতত্ত্ব।

উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম ইতিহাসচর্চার সূত্রপাত হয় গ্রিসে। ইতিহাসের জনক হিরোডোটাসের (৪৮৪-৪২০ খ্রিঃ পূঃ) ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য সময় ও অবস্থানের প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয়েছে। হিরোডোটাসের ইতিহাসচর্চার মধ্যদিয়ে প্রাচীন ইতিহাসতত্ত্বের সূচনা হলেও থুসিডিডিস (৪৫৬-৩৯৬ খ্রিঃ পৃঃ) একে অনেকটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্মত করতে সক্ষম হন। এর দীর্ঘকাল পর রেনেসাঁ যুগেও ইতিহাসতত্ত্ব আধুনিকরূপ লাভ করতে পারেনি। জার্মান ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ভন রাংকে (১৭৮৫-১৮৮৬ খ্রিঃ) বিগত দু’শতকেরও ইতিহাস ও কম সময় পূর্বে আধুনিক ইতিহাসতত্ত্বের সূচনা করেন। তিনি ইতিহাসকে সম্যকভাবে জানা, বুঝা, উপলব্ধি করা, উৎসানুসন্ধানের জন্য নিয়মানুঃ পদ্ধতি তথা বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল প্রয়োগ করা এবং সুসংবদ্ধ প্রক্রিয়ায় ইতিহাস পঠন-পাঠন ও অনুশীলনের সূচনা করেন। আর এভাবে রাংকের মাধ্যমে উনিশ শতকে আধুনিক ইতিহাসতত্ত্বের সূচনা হয়।

ইতিহাসতত্ত্বের বিষয়বস্তু ও পরিধি

ইতিহাসতত্ত্ব বলতে মূলত ইতিহাস পঠন-পাঠন, ইতিহাস লিখন ও অনুশীলনকে বুঝানো হলেও এর পরিধি ও বিষয়বস্তু অনেক ব্যাপক। যথাযথ অর্থে ইতিহাসের সংজ্ঞা, আলোচ্য বিষয়, বৈশিষ্ট্য, উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা ইতিহাসতত্ত্বের বিষয়বস্তু। তাছাড়া ইতিহাস ও যুগ বিভাজন, ইতিহাসের বিভিন্ন শাখা, ইতিহাসের সাথে বিভিন্ন বিষয়ের সম্পর্ক, ইতিহাসের সকল প্রকার উৎস, ঐতিহাসিক ও ইতিহাস দার্শনিকদের ইতিহাস সংক্রান্ত কর্মের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ, প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগে ইতিহাসের স্বরূপ ও গুরুত্ব সম্পর্কিত বিভিন্ন দিকও ইতিহাসতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।

সাধারণত রীতি ও পদ্ধতির মধ্যে যেমন পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়, তেমনি ইতিহাস ও ইতিহাসতত্ত্বের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বৃষ্টিতে যাতে কাপড় ভিজে না যায় সেজন্য বৃষ্টিভেজা হতে কাপড় রক্ষা করাটা একটা সাধারণ রীতি এবং কাপড়কে ভেজা হতে যেভাবে রক্ষা করা হয় তা হল পদ্ধতি। যেমন- ছাতা ধরে বৃষ্টিভেজা হতে রক্ষা করা যেতে পারে অথবা -কোন ঘরে আশ্রয় নিয়েও বৃষ্টিভেজা হতে রক্ষা করা যেতে পারে। আর এ রক্ষা করার ধরনের নাম হল পদ্ধতি। কোন বিষয়, ঘটনা বা কর্মের ওপর প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে লিখিত বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ হল ইতিহাস (History)। আর যে পদ্ধতিতে, যে কৌশলে ও যে জ্ঞানের দ্বারা ইতিহাস পঠন-পাঠন, লিখন ও সার্বিকভাবে ইতিহাস— অনুশীলন করা হয় তাহল ইতিহাসতত্ত্ব (Historiography)। যেকোন লোক ইতিহাস পড়তে পারে ও জানতে পারে। কিন্তু ইতিহাসকে বুঝতে হলে ও উপলব্ধি করতে হলে ইতিহাসতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। ইতিহাসতত্ত্ব সম্পর্কে অনুরাগী ব্যক্তির মধ্যেই শুধু ইতিহাসবোধ জন্মলাভ করতে পারে। পক্ষান্তরে যেকোন সাধারণ মানুষের মধ্যেও ইতিহাসের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হতে পারে। একজন Historian History পড়তে, বুঝতে, লিখতে ও উপলব্ধি করতে পারলেও তার পক্ষে Historiography তথা Historical thought সহজবোধ্য নাও হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে Historiography লেখার জন্য অবশ্যই একজন Historiographer দরকার। একজন Historiographer অতি সহজেই সকল প্রকার ইতিহাস পড়তে, বুঝতে লিখতে পারেন। একজন Historiographer-কে ইতিহাস বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি বলেও অভিহিত করা যায়। কিন্তু একজন Historian ইতিহাস বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নাও হতে পারেন। একজন Historian ইতিহাস বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করার পাশাপাশি ইতিহাসবোধের দ্বারা বিশেষভাবে আলোকিত হলে Historiographer-এর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন ।

সম্পর্কিত আর্টিকেল

ইতিহাসের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা কর

ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য সমূহ কি কি? 

ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর

Related Posts