1.1K
ইতিহাস শব্দের উৎপত্তি
“ইতিহাস’ শব্দটি সংস্কৃত ‘ইতিহ’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। সাধারণত ‘ইতিহ’ শব্দ দ্বারা ‘ঐতিহ্য’কে বুঝানো হয়ে থাকে। ইতিহাস শব্দের আভিধানিক অর্থ পুরাবৃত্ত, ইতিবৃত্ত বা প্রাচীন বৃত্তান্ত (Past events)। তাছাড়া ইতিহাস শব্দ দ্বারা A true story অথবা A methodical record of public events বুঝানো হয় । ইতিহাস শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ History। ল্যাটিন শব্দ Histor (জ্ঞান) ও গ্রিক শব্দ Historia (অনুসন্ধান) হতে History শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। তবে Historia শব্দের যথার্থ অর্থ An inquiry, designed to elicit truth অর্থাৎ- সত্য প্রকাশ করার জন্য পরিকল্পিত অনুসন্ধান ।
উপর্যুক্ত শাব্দিক বিশ্লেষণের আলোকে বলা যায়, ইতিহাস বলতে আমরা এমন একটি বিষয়কে বুঝে থাকি যে বিষয়টি ঘটে যাওয়া বিষয়ের ওপর পরিকল্পিতভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে আমাদের সামনে সঠিক তথ্যকে উপস্থাপন করে। গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস সর্বপ্রথম তাঁর গবেষণাকর্মের শিরোনামে History শব্দটি ব্যবহার করেন এবং আজ পর্যন্ত বিষয়টি সে নামেই পরিচিত হয়ে আসছে। বলতে গেলে ইতিহাস বিষয়ক পঠন-পাঠনে উপযুক্ত শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করে আজও তিনি ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত হয়ে আছেন। উল্লেখ্য, তিনি সর্বপ্রথম মানুষের অতীত কার্যক্রমের তথ্যনির্ভর বিবরণকে শুধু History বলে অভিহিত করেননি, বরং তিনি সর্বপ্রথম রীতিসিদ্ধভাবে ইতিহাসচর্চার সূত্রপাত করেন। এজন্যও তাঁকে ইতিহাসের জনক বলে আখ্যায়িত করা হয়।
হিরোডোটাস ইতিহাসের জনক নামে পরিচিত হলেও তার পূর্বেও Historia শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। হিরোডোটাসের পূর্বে বিখ্যাত গ্রিক কবি হোমারের প্রসিদ্ধ কাব্য ইলিয়াডে (Iliad) Historia শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এ কাব্যগ্রন্থে দেখা যায় যে, দুটি বিবদমান দল আইনের আশ্রয় নিতে গিয়ে চিৎকার করে বলে, “এট্রিসের ছেলে এগামেমননকে আমাদের সালিস বা Histor নিযুক্ত করি (Let us make Agamemon Atreus’ son our arbitrator or our histor) | Histor দ্বারা হোমার এখানে সুস্পষ্টভাবে গোত্রীয় আইন-কানুন ও আচার-আচরণে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিকে বুঝিয়েছেন। একজন Histor-এর পক্ষে তথ্যাবলি অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করে সত্য প্রতিষ্ঠা তথা ন্যায়বিচার করা সম্ভব ছিল। অবশ্য হিরোডোটাসের কৃতিত্ব হল তিনি তাঁর ইতিহাস জাতীয় গবেষণাকর্মের ধরন ও চরিত্র বুঝতে গিয়ে সর্বপ্রথম Historia শব্দটি চয়ন করে শিরোনামে ব্যবহার করেন। এরপর থেকে সাহিত্য ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয় এবং আজও ইতিহাস গবেষণার সাথে History শব্দটি সংশ্লিষ্ট আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
আরও পড়ুন: জুম চাষ কি, কিভাবে করা হয়?
ইতিহাসের সংজ্ঞা
ইতিহাসের একক ও সর্বজনীন সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়। সময়, অবস্থা ও ইতিহাসের গুরুত্বগত দিক বিশেষ বিবেচনা করে বিভিন্ন যুগধর্মের প্রেক্ষিতে ইতিহাসের অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা ও বোধগম্যতার সুবিধার্থে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্নভাবে ইতিহাসের সংজ্ঞা দেয়ার প্রয়াস পান। এ প্রসঙ্গে গ্রন্থের ‘প্রাসঙ্গিক কথা’ শীর্ষক ভূমিকায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে বিধায় এখানে তা পুনরুল্লেখ না করাই শ্রেয়। উল্লেখ্য, কোন ঐতিহাসিকই সকল যুগ ও সকল সমাজের জন্য ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট, সর্বজনীন বা অপরিবর্তনীয় সংজ্ঞা দিতে পারেনি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্নভাবে ইতিহাসের যে সকল সংজ্ঞা দেয়ার প্রয়াস পান তা নিম্নোক্তভাবে আলোচনা করা যায়। যেমন- B. D. Ghate-এর মতে, “It (history) is a scientific study and a record of our complete past.” অর্থাৎ এটি বিজ্ঞানসম্মত পাঠ এবং মানবজাতির সম্পূর্ণ অতীতের একটি জীবন্ত প্রামাণ্যচিত্র। আবার অন্যভাবে বলা যায়, ইতিহাস হচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের বিবর্তন ও ক্রমবিকাশের একটি প্রামাণ্য দলিল। তাছাড়া ইতিহাসের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে বলা যায়, অতীতে মানুষ যা করেছে, বলেছে ও চিন্তা করেছে প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে সেগুলোর লিখিত বিবরণ হল ইতিহাস ।
Fire Vedic Age গ্রন্থে ইতিহাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, “History has been defined as the study of man’s dealings with other men and the adjustment of working relations between human groups.” অর্থাৎ মানুষ ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে আদান-প্রদান, সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের ফলে বৃহত্তর মানব সমাজের ক্রমোন্নতির ধারাবাহিক বিবরণ হল ইতিহাস। আবার বলা যায়, কোন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে কোন নির্দিষ্ট সময়ে কোন মানুষ বা জনসমষ্টি কর্তৃক সম্পাদিত কর্মের প্রামাণ্য তথ্যভিত্তিক বস্তুনিষ্ঠ লিখিত ও ধারাবাহিক বিবরণ হল ইতিহাস। আমাদের মতে এটাই ইতিহাসের অধিকতর গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা।
উনিশ শতকের একজন বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক Freeman ইতিহাসকে ‘Past Politics’ বলে অভিহিত করেছেন। আমরা Freeman-এর উক্তিটি ব্যাখ্যা করলে দেখতে পাব যে তার মতামতটি সম্পূর্ণ সত্য না হলেও আংশিক সত্য। কারণ রাজনৈতিক ইতিহাস প্রকৃতপক্ষেই Past Politics আজকের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বগণ দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে দেশের জনগণকে সংগঠিত ও বিন্যস্ত করার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন অর্থাৎ যে সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন আগামীতে তা হবে ইতিহাস। অন্যভাবে বলা যায়, আজকের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানগণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত এবং তারা যা করছেন তা তাৎক্ষণিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে পরিচিত। উল্লেখ করা যেতে পারে, আজকের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বগণ আগামীতে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন এবং তাদের কার্যাবলি তখন ইতিহাস হিসেবে গণ্য হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্যাবিলনের সম্রাট হাম্মুরাবি, ম্যাসিডনের রাজা গ্রিকবীর আলেকজান্ডার, ভারতের পুষ্যভূতি বংশের রাজা হর্ষবর্ধন, এমনিভাবে সম্রাট বাবর, সম্রাট আকবর, ভাইসরয় লর্ড কার্জনসহ অনুরূপ সকলেই ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং তাদের কার্যক্রমগুলো ছিল রাজনৈতিক কার্যক্রম। তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমগুলো সমসাময়িককালে রাজনীতি বলে গণ্য হলেও সময় গত হবার পর আজ তা রাজনৈতিক ইতিহাস হিসেবে গণ্য। তাদের কার্যক্রমগুলোকে আজ সামাজিক ইতিহাস, অর্থনৈতিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ধর্মীয় বিবর্তনের ইতিহাস বা দার্শনিক ইতিহাস বলা যাবে না।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক Edward Hallett Car তাঁর ‘What is History’ গ্রন্থে বলেছেন, “History consists of a corpus of ascertained facts. The facts are available to the historian in documents, inscriptions and so on, like fish on the fishmonger’s slab.” আবার বিখ্যাত ঐতিহাসিক R. G. Collingwood-এর মতে, ইতিহাস হচ্ছে Re-enactment of past experience. তাছাড়া তার মতে, History is an inquiry about the actions of human being that have done in the past. The subject matter of history is not the past as such but the past far which we have evidence. R. G. Collingwood-এ ব্যাপারে আরো বলেন, “সকল ইতিহাসই চিন্তা-চেতনার ইতিহাস এবং যাদের ইতিহাস অনুসন্ধান করা হয় তাদের চিন্তা-ভাবনা ঐতিহাসিকের মনে পুনর্গঠন করা ইতিহাসেরই নামান্তর” ।
ঐতিহাসিকের মনে অতীত ঘটনার পুনর্গঠন দৃষ্টবাদী তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এটা দৃষ্টবাদী প্রক্রিয়া নয় এবং কেবল তথ্যের বর্ণনায় এটা সীমিত থাকতে পারে না। অপরপক্ষে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া তথ্য নির্বাচন ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে প্রভাব ফেলে ঐতিহাসিক তথ্য তৈরি করে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ইতিহাস ঐতিহাসিকের অভিজ্ঞতার ফসল। ঐতিহাসিক ও ইতিহাসের তথ্য পরস্পরের নিকট প্রয়োজনীয়। তথ্য ছাড়া ঐতিহাসিক শিকড়হীন ও বিফল। আবার তথ্যও ঐতিহাসিক ছাড়া মৃত ও অর্থহীন। সুতরাং বলা যায়, ইতিহাস হল ঐতিহাসিক ও তথ্যের মধ্যকার পারস্পরিক অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া এবং বর্তমান ও অতীতের মধ্যকার এক অন্তহীন সমীক্ষা। Encyclopedia Britannica-তে ইতিহাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে- History includes all that has happened of everything that is subject to change. History is the past experience of society.
সবশেষে বলা যায়, পৃথিবীতে মানুষের আগমন ও ক্রমবিবর্তন, সভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের আদ্যপান্তের চিত্তাকর্ষক ও প্রামাণ্য সমীক্ষা হল ইতিহাস। একটি মানুষের জীবনে, একটি পরিবারে, একটি সমাজে, একটি রাষ্ট্রে, এমন কি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যেকোন স্থানে সংঘটিত ও প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে লিখিত ঘটনাসমূহের ধারাবাহিক খতিয়ান হল ইতিহাস। বস্তুত History is the root of all kinds of studies। ইতিহাস ব্যতীত কোন ব্যক্তি, বিষয় ও জাতি কল্পনা করা যায় না। সুতরাং বর্তমান বিশ্বের পঠন-পাঠনের বিষয়গুলোর মধ্যে ইতিহাস অবশ্যই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।