মধ্যযুগে যেসব মুসলিম মনীষী তাঁদের মৌলিক চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞান-সাধনার দ্বারা বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন আবু সায়েদ ওয়ালিউদ্দিন আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে খালদুন অন্যতম। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর ছিল দীপ্ত পদচারণা। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত তাঁর আসাবিয়া তত্ত্ব বেশ উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, আইনবিদ, রাজনৈতিক ও সমাজবিজ্ঞানী। সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য অনেকে তাকে প্রাচ্যের এরিস্টটল নামে অভিহিত করে থাকেন।
ইবনে খালদুনের পরিচয়
ইবনে খালদুন ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার তিউনিশ শহরে এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি কুরআন, হাদিস, ভাষাতত্ত্ব, আইনশাস্ত্র, ইতিহাস ও দর্শনে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। ২০ বছর বয়সে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি বহু রাজবংশের উত্থান- পতন অবলোকন করেন এবং আরব, বর্বর ও অন্যান্য বহু জনগোষ্ঠীর জীবনধারার সাথে পরিচিত হয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এ অভিজ্ঞতা তাঁর মৌলিক চিন্তা- চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছিল।
ইবনে খালদুনের আসাবিয়া তত্ত্ব
ইবনে খালদুনের রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আসাবিয় তত্ত্ব “আসাবিয়া” নামক প্রত্যয়টির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তিনি তার সমগ্র রাষ্ট্রদর্শনে আসাবিয়া বা গোষ্ঠী সংহতির উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিকাশ, অবক্ষয় ও পতন সবকিছুই গোষ্ঠী সংহতির আনুপাতিক পরিমাণের উপর নির্ভরশীল। আসাবিয়ার মাধ্যমে গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীর অধিপতি রাজনৈতিক কর্ম-প্রয়াসের ক্ষেত্রে তার ঐক্যবদ্ধ মানসের প্রতিফলন ঘটাতে পারে এবং এরই ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। আসাবিয়া শব্দের ইংরেজি অর্থ Social Solidarity, যার বাংলা অর্থ সামাজিক সংহতি অর্থাৎ গোষ্ঠীর সমন্বিত মানস। তাঁর মতে, এ সামাজিক সংহতির ভিত্তি রচিত হয় মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থেকে। মানুষ জীবন-ধারণ এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অনুভব করে।
টোটেম কি? টোটেম ও ট্যাবু কি? |
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ইবনে খালদুন পূর্বের সকল কাল্পনিক ও ভ্রান্ত মতবাদসমূহকে বাতিল করে ঘোষণা করে তিনি বলেন যে, মানবজীবনের স্বাভাবিক প্রয়োজনের তাগিদে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। কেননা Aristotle এর ন্যায় তিনিও মনে করতেন, মানুষ স্বভাবতই সামাজিক ও সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ একা বেঁচে থাকতে পারে না। কারণ প্রতিটি ব্যক্তি তার একক শক্তির মাধ্যমে নিজের সবটুকু অভাব- অভিযোগ মোচন করতে পারে না। অতএব বলা চলে, মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে সমাজ গড়ে উঠে।
ইবনে খালদুন বলেন, মানুষের স্বভাবে ও প্রকৃতিতে পশুসুলভ মনোবৃত্তি বিদ্যমান। এ মনোবৃত্তির ফলেই সমাজে কলহ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং পরিণামে সামাজিক সংহতি নষ্ট হয়। এ দ্বন্দ্ব-কলহ ও বিরোধ দূর করার জন্য দরকার হয় এক শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তির, যিনি ক্ষমতা বা আধিপত্যের মাধ্যমে জনগণকে কলহ ও দ্বন্দ্ব হতে বিরত রাখতে পারে। এরূপ কর্তৃত্ব বা শক্তি সার্বভৌম নামে পরিচিত। এটি জনগণের মধ্যে সংহতি বজায় রাখতে অপরিহার্য। রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় এ উপাদানের কথা ইংল্যান্ডের সমাজদার্শনিক টমাস হবসের কথায় প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠে।
ইবনে খালদুনের মতে, আসাবিয়া বা গোষ্ঠী সংহতির প্রথম উন্মেষ ঘটে পরিবার এবং গোত্রীয় সংহতির মাধ্যমে। অতঃপর গোত্রীয় এলাকা সম্প্রসারিত হয়ে যখন রাষ্ট্রের উৎপত্তি আসন্ন হয়ে দাঁড়ায় তখন ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি সম্পন্ন একাধিক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে অনিবার্য সংঘাত দেখা দেয়। একটিমাত্র গোষ্ঠী অন্য সব গোষ্ঠীর উপর যখন চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে তখনই যথার্থ রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত দ্বান্দ্বিক মতবাদের প্রবক্তা ওপেন হাইমার ও গামগ্লোভিজের সাথে তুলনা করা যেতে পারে ইবনে খালদুনকে।
ইবনে খালদুনের মতে, আসাবিয়া গড়ে উঠার একটি অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান হলো রক্তের সম্পর্ক। রক্তের সম্পর্ক পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রাথমিকভাবে জ্ঞাতিগোষ্ঠী রক্তের সম্পর্কের উপর নির্ভর করে সংহতি গড়ে উঠে। যার ফলশ্রুতি হিসেবে গড়ে উঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজ। রক্ত সম্পর্কিত জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি খুবই প্রবল। যাযাবর গোত্রগুলোর মধ্যে রক্ত সম্পর্কিত সংহতি বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।
ধর্মের ভিত্তিতে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি বা আসাবিয়া গড়ে উঠে। তিনি ধর্মকে সংহতির মূলভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নবী-রাসূলগণ যে ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে আবির্ভূত হন তার মধ্যে যে প্রচণ্ড ঐক্য বিধানকারী ক্ষমতা রয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ধর্ম ও রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও দীর্ঘদিন একই স্থানে বসবাস এবং দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব ও যোগাযোগের ফলে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতির উদ্ভব ঘটতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা |
ইবনে খালদুন রাষ্ট্রকে জীবদেহের সাথে তুলনা করেছেন। জীবদেহের মতো রাষ্ট্রেরও বিকাশ, পূর্ণতা ও পতন আছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের উদ্ভব, বিকাশ ও পতনের পেছনে যে উপাদান ক্রিয়াশীল সেটি হলো আসাবিয়া বা গোষ্ঠী সংহতি। রাষ্ট্র সৃষ্টির সময় কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে আসাবিয়া প্রবল থাকে, পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে কোন রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণের মধ্যে আসাবিয়া বা গোষ্ঠী সংহতি হ্রাস পেতে থাকে। এক পর্যায়ে আসাবিয়ার অনুপস্থিতির কারণে রাষ্ট্রের পতন অনিবার্য হয়ে উঠে। ইবনে খালদুনের মতে, রাষ্ট্রের স্বাভাবিক আয়ু তিন পুরুষ অর্থাৎ ১২০ বছর। এই তিন পুরুষে রাষ্ট্র তার পরিবর্তনের পাঁচটি স্তর অতিক্রম করে ধ্বংসের পথে বিলীন হয়ে যায়।
খালদুনের মতে, রাষ্ট্র যে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি স্তর অতিক্রম করে চলে। তা নিম্নরূপ:
প্রথম পর্ব বা বিজয় পর্ব: এ পর্বে আসাবিয়া বা গোষ্ঠী সংহতি অটুট থাকে। এ পর্বে গোষ্ঠী সংহতির মাধ্যমে শাসক শত্রুকে পরাজিত করে। এ সময় শাসকও আসাবিয়ার চাহিদা মোতাবেক জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে রাষ্ট্রীয় শাসন কাজ পরিচালনা করে।
দ্বিতীয় পর্ব বা রাষ্ট্র সংগঠনের পর্ব: এ পর্বে রাষ্ট্র সংগঠিত হয় এবং নগর সভ্যতার বিকাশ শুরু হয়। নগর সভ্যতার প্রভাবে জনগণ আরাম-আয়েশের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তাদের গোষ্ঠী সংহতি কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে। এরই সুযোগে শাসক জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা করে এবং সার্বভৌম ক্ষমতা অর্জন করেন। জনগণ রাষ্ট্র শাসনের যে অংশীদারিত্ব দাবি করে তা শাসক প্রত্যাখান করেন এবং ভাড়াটিয়া লোক ও চাটুকারদের সাহায্যে তাঁর শাসন কায়েম করার প্রয়াস পান। পরিশেষে সব ক্ষমতা তিনি নিজ পরিবারের মধ্যে কুক্ষিগত করেন।
তৃতীয় পর্ব বা বিশ্রাম ও আরাম পর্ব: এ পর্বে জনগণ গোষ্ঠী সংহতি হারিয়ে আরামপ্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে শাসক রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের যাবতীয় সুফল নিজেই ভোগ করতে শুরু করে। এ সময় শাসক সরকারি কর ও পাওনা নিয়ন্ত্রণ করে এবং অর্থব্যয়ে মিতাচার আরম্ভ করে। একই সাথে স্মৃতিস্তম্ভ ও প্রাসাদ নির্মাণে মনোযোগ দেয়, পরিবার ও সমর্থকদের প্রতি উদারতা দেখায়।
চতুর্থ পর্ব বা অবনতির পর্ব: এ পর্বে নগর সভ্যতার প্রভাবে জনগণের গোষ্ঠী সংহতি বিনষ্ট হয়ে যায় এবং শাসকের মধ্যে একটা নিষ্ক্রিয়ভাব দেখা যায়। তিনি তার পূর্বপুরুষদের কার্যকলাপে সন্তুষ্ট থাকেন। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার সাথে শান্তিতে বসবাস করতে চান এবং যথাসম্ভব পূর্বপুরুষদের অনুকরণ করেন।
পঞ্চম পর্ব বা চরম বিলাসিতা ও ধ্বংসের পর্ব: এ পর্বে জনগোষ্ঠী গোষ্ঠী সংহতি সম্পূর্ণ হারিয়ে হীনবল হয়ে পড়ে। এ পর্বে শাসক তার পূর্বপুরুষদের সঞ্চয়কৃত যাবতীয় সম্পদ নষ্ট করে কেবল ভোগ-বিলাসের জন্য। শাসক দেশের গুণীজনের আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং তাদের অন্তরে ঘৃণা ও বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। এর ফলে কোন শক্তিশালী সমাজ অথবা আদিম ঐক্যবদ্ধ সমাজের আক্রমণ আর প্রতিহত করা যায় না। ফলে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
ইবনে খালদুন বর্ণিত রাষ্ট্রের উত্থান ও পতন সম্পর্কিত এ তথ্যটি চক্রাকার তত্ত্ব নামে পরিচিত। বর্তমান সমাজতত্ত্ববিদ ও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ববিদদের কাছে এ তত্ত্বটির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
সমালোচনা
ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রের উৎপত্তির সাথে সম্পর্কিত আসাবিয়া তত্ত্ব সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তিনি তাঁর আসাবিয়া ধারণায় শাসক ও রাষ্ট্রকে এক করে ফেলেছেন। এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য টানতে পারেননি।
রাষ্ট্রের উৎপত্তির প্রশ্নে খালদুন বলেছেন, উপজাতীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয় অথচ এভাবে আধুনিক যুগে রাষ্ট্রের উৎপত্তি তেমনভাবে দেখা যায় না।
রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে ইবনে খালদুন যে সামাজিক সংহতির কথা বলেছেন তার চেয়ে আধুনিক জাতীয়তাবাদের ধারণা ব্যাপকতর। এছাড়া রাষ্ট্রের আয়ুষ্কাল সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা বাস্তবের সাথে মিল নেই।
পরিশেষে বলা যায় ইবনে খালদুনের আসাবিয়া বা গোষ্ঠী সংহতি প্রাচীন বা মধ্যযুগের রাষ্ট্রের উৎপত্তিই মূল উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। গোষ্ঠী সংহতির মাধ্যমেই রাষ্ট্র সৃষ্টি এবং তার অনিবার্য অনুসঙ্গ হিসেবে শাসনের অভ্যুদয় ঘটে, যিনি ব্যাপক সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। অতএব বলা যায়, রাষ্ট্রের উৎপত্তি থেকে তার ধ্বংস পর্যন্ত সবকিছুর মূলে রয়েছে আসাবিয়া। তাছাড়া পরিবেশ ও জলবায়ুর পার্থক্যের কারণে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ভিন্নতর হতে পারে। এ সম্পর্কে তিনি একটি নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা ইবনে খালদুনের আসাবিয়া তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করলেন।