Home » উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা

উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা

by Rezaul Karim
উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশ্বায়নের প্রভাব, উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বায়নের প্রভাব,

উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশ্বায়নের প্রভাব কেমন তা আমরা অধিকাংশই জানি না। আজকের লেখায় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করবো।

উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বায়নের প্রভাব

বিশ্বায়ন উন্নত বিশ্বের সৃষ্টি। বলা হয়ে থাকে, উন্নত বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে শোষণ করার পরিবর্তে পরোক্ষভাবে শোষণ করার জন্য বিশ্বায়নের ধূম্রজাল সৃষ্টি করছে। বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে দরিদ্র আরো দরিদ্র হচ্ছে, নিঃস্ব আরো নিঃস্ব হচ্ছে। উন্নত বিশ্ব বিশ্বায়নের নামে বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে বিশ্ব জুড়ে চালাচ্ছে অব্যাহত শোষণ ও লুণ্ঠন প্রক্রিয়া। তথাপি কেউ কেউ বিশ্বায়নকে দেখছেন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আশীর্বাদরূপে। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বব্যাপী দু’ধরনের প্রভাব পড়ছে। এর মধ্যে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাব রয়েছে।

তৃতীয় বিশ্বে বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাব যেসব তাত্ত্বিকেরা বিশ্বায়নকে তৃতীয় বিশ্বের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতির সহায়ক মনে করেন তাদের ধারণানুযায়ী তৃতীয় বিশ্ব তথা উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশ্বায়নের প্রভাব নিম্নরূপ:

১. প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি

তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় উন্নয়ন ঘটাতে পারছে না। কিন্তু বিশ্বায়নের বদৌলতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে। এর ফলে উন্নয়নের বহুমুখী সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

২. রেমিট্যান্স বৃদ্ধি

বিশ্বায়ন বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশ, জাতি ও অঞ্চলের মধ্যে বহুমুখী সম্পর্কের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এর ফলে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ লোক উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন কর্মসংস্থানে নিয়োজিত আছে। তাদের প্রেরিত অর্থ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করছে।

বিশ্বায়ন কি | বিশ্বায়ন কাকে বলে | বিশ্বায়ন বলতে কি বুঝ

৩. প্রাইভেট সেক্টরের সমৃদ্ধি

বিশ্বায়নের ফলে পুঁজিপতি শ্রেণী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অর্থ বিনিয়োগ করছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রাইভেট সেক্টরে দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রাইভেট সেক্টরের সমৃদ্ধি হচ্ছে।

৪. প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ

বিশ্বায়নের ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অনুন্নত বিশ্বে বিভিন্ন খাতে সরাসরি বিনিয়োগ করছে। পারস্পরিক আস্থা নির্ভরশীলতার কারণে বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।

৫. বাজার সুবিধা সৃষ্টি

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিলসহ পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে জনসংখ্যা স্ফীতির কারণে বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে বিশ্বায়নের কারণে উন্নত বিশ্বের পণ্য যেমন অনুন্নত বিশ্বে অনুপ্রবেশ ঘটছে আবার পণ্যের গুণগত মান দিয়ে অনুন্নত বিশ্বও উন্নত বিশ্বে বাজার সুবিধা সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কথা বলা যেতে পারে।

৬. বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি

বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে। তাছাড়া পেশার বৈচিত্র্যতা এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও অর্থনৈতিক গতিশীলতার কারণে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে।

৭. মানব উন্নয়ন কর্মসূচি

মানব উন্নয়ন কর্মসূচিতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো পিছিয়ে ছিল। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বিভিন্ন মানব উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

৮. নারীর ক্ষমতায়ন

জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সেক্টরে নারীদের ভূমিকা ছিল নগণ্য। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক না অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের সরব উপস্থিতি ও অংশগ্রহণে উন্নয়নের চাকা সচল হয়েছে। নারীরা আর চার দেওয়ালে বন্দি না থেকে পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন হয়েসূচিতে অংশ নিচ্ছে। নারীরা আজ আর পুরুষের হাতের ক্রীড়নক নয়। তারা পারিবারিক কাঠামো থেকে শুরু করে সমাজ বিনির্মাণে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে।

৯. শিল্পায়ন ও নগরায়ণ

বিশ্বায়নের একটি ইতিবাচক দিক হলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিল্পের বিকাশ সাধিত হচ্ছে। তাছাড়া গ্রামের মানুষ অধিক হারে শহরে অভিগমন করে শহরের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে, ফলে নগরায়ণ ত্বরান্বিত হচ্ছে।

১০. সংস্কৃতির বিকাশ

ইন্টারনেট, মোবাইল, সেটেলাইট তথা তথ্য প্রযুক্তির অব্যাহত অগ্রগতির কারণে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকের অনুপ্রবেশ ঘটছে। ফলে দেশীয় সংস্কৃতি পরিপুষ্ট হয়ে ক্রমশ তার বিকাশ সাধিত হচ্ছে।

১১. স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন

বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে বিশ্বের সকল মানবগোষ্ঠী তাদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে। পরিবেশ দূষণ, রোগ, মহামারি এবং এইডস এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে।

১২. পর্যটন শিল্পের বিকাশ

বিশ্বায়ন হলো সকলকে একই পতাকাতলে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া। আর সে কারণেই এক দেশের লোক সহজেই অন্য দেশের সমাজ, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে এবং নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি অবলোকন করতে পরিভ্রমণ করছে। ফলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত হচ্ছে।

১৩. গণতন্ত্রায়নের দিকে অগ্রযাত্রা

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা হতো না। যুগের পর যুগ সেখানে পরিবারতন্ত্র ও সামরিক বাহিনী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছিল। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো রাজনৈতিক দিক দিয়ে গণতন্ত্রায়নের দিকে যাত্রা শুরু করেছে এবং এর সুফল ইতোমধ্যে তারা পেতে শুরু করেছে।

তাছাড়া বিশ্বায়নের ফলে অর্থনৈতিক সেক্টরে উন্নতি, ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়নের সুযোগ এবং যৌথ নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে।

তৃতীয় বিশ্বে বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব অনেক তাত্ত্বিক বিশ্বায়নের ফলে কিছু নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো নিম্নরূপ:

১. দেশীয় শিল্পের ধ্বংস সাধন

বিশ্বায়নের ফলে পণ্যের অবাধ প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এদেশের শিল্প বিকাশে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। তারা উন্নততর যান্ত্রিক কলাকৌশল ব্যবহার করছে। ফলে তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে দেশীয় শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের তাঁতশিল্প ও মৃৎশিল্পের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

২. কৃষি অর্থনীতির বিকাশ রোধ

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো কৃষি। কৃষি অর্থনীতির চাকা সচল রাখলে এ দেশগুলো উন্নয়নের দিকে ধাবিত হতে পারে। কিন্তু উন্নত বিশ্ব বিশ্বায়নের নামে অনুন্নত বিশ্বের কৃষি অর্থনীতির বিকাশের পথ রুদ্ধ করছে। শিল্পায়নের নামে তাদের উপর নির্ভরশীল করে তুলছে।

৩. দারিদ্র্যের লালন

নির্ভরশীল তাত্ত্বিকেরা মনে করেন, অনুন্নত বিশ্বের দারিদ্র্যের মূল কারণ হলো উন্নত বিশ্বের উপর নির্ভরশীলতা। অনুন্নত বিশ্বের বিরাট বাজার দখল করার জন্য উন্নত বিশ্ব বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার নামে এবং বিশ্বায়নের বুলি আওড়িয়ে তাদের উপর নির্ভরশীল করে তুলছে। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো দারিদ্র্যকে কেবল লালনই করে যাচ্ছে, এর থেকে উত্তরণের কোন কার্যকরী পন্থা গ্রহণ করতে পারে নি।

সামাজিক পরিবর্তনের তত্ত্ব সমূহ আলোচনা কর

৪. শহর ও গ্রামের বিরোধ বৃদ্ধি

বিশ্বায়নের ফলে শহরের সমৃদ্ধি ঘটলেও গ্রামকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। গ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয় নি। তাছাড়া কর্মসংস্থানের জন্য গ্রাম থেকে মানুষ ক্রমশ শহরমুখী হচ্ছে। ফলে শহর ও গ্রামের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে এবং গ্রামীণ উন্নয়নের মুখ থুবড়ে পড়ছে।

৫. দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ রোধ

বিশ্বায়নের সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশীয় সংস্কৃতির উপর। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে অতি সহজেই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটছে। দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশের পথ ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে পড়ছে।

৬. মেধা পাচার

বিশ্বায়নের ফলে এদেশের তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বিদেশে গিয়ে এদেশের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সেক্টরে কৃতিত্বের পরিচয় দিচ্ছে। ফলে তারা সেসব দেশেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করছে। এভাবে এসব দেশ ক্রমে মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে।

৭. পাশ্চাত্যকরণ

বিশ্বায়নের ফলে এদেশের মানুষের আচার ব্যবহার, রীতিনীতি ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা পাশ্চাত্য ধাঁচে জীবনযাপন করছে, এমনকি শিক্ষার ক্ষেত্রেও পাশ্চাত্য রীতিনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এভাবে বিশ্বায়নের ফলে পাশ্চাত্যকরণ হচ্ছে।

পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বায়নের যত নেতিবাচক প্রভাবই থাকুক না কেন, বৃঢ় বাস্তবতা হলো বিশ্বায়ন সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এরূপ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কোন দেশ দূরে থাকতে পারে না। নতুন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের ততটাই আগানো উচিত, যতটা আমাদের দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তার জন্য প্রয়োজন মানবসম্পদ উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সম্পদের সুষম বণ্টন ও সমৃদ্ধ প্রশাসনিক কাঠামো। তবেই বিশ্বায়নের পথে বাংলাদেশের যাত্রা হবে ফলদায়ক। আর তাই বিশ্বায়নকে নব্য উপনিবেশবাদ বলে বসে না থেকে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে বিশ্বপল্লির সদস্য হওয়ার জন্য উন্নতির গতিশীল ধারা অব্যাহত রাখা উচিত।

আশাকরি, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশ্বায়নের প্রভাব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করেছেন। 

Related Posts