এমিল ডুর্খেইম সামাজিক ঘটনা তত্ত্ব একটি খুব আলোচিত বিষয়। আজকে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো
এমিল ডুর্খেইম সামাজিক ঘটনা বর্ণনা
সামাজিক ঘটনাবলি ব্যক্তিজীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করে সে বিষয়ে ডুর্খেইম আলোচনা করেছেন। “The Rules of the Sociological Method‘ গ্রন্থে তার উদ্ভাবিত প্রথম সূত্র হলো; “…… to consider social facts as things. (Emile Durkheim, les regles, P.20)। অর্থাৎ, সামাজিক ঘটনাবলিকে বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার প্রথম ধাপ। ডুর্খেইম দাবি করেন যে, বিভিন্ন সামাজিক ঘটনাসমূহকে বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা দরকার। তারা বাহ্য জগতের বস্তু বা পদার্থের মতো।
ডুর্খেইমের মতানুসারে আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি, সামাজিক বাধ্যবাধকতা প্রভৃতি যা প্রত্যেক ব্যক্তিকে নৈতিকভাবে সামাজিক চাপের মধ্যে থাকতে বাধ্য করে তাকে বা সে অবস্থাকে সামাজিক ঘটনা বলে। সামাজিক ঘটনা বলতে বুঝায়, যে কোন কার্যকারণের প্রকৃতি যা ব্যক্তির উপর বাহ্যিক চাপের সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুন: এমিল ডুর্খেইম এর পরিচয় দাও
সমাজবাদীরা ‘আইন’ সামাজিক ঘটনার বাহ্যিক চাপের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু এগুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নাও হতে পারে। শিল্পনির্ভর সমাজে লোকসংখ্যার ঘনত্ব, অপরাধ প্রভৃতি সামাজিক ঘটনা। আবার আত্মহত্যা, মদ্যপান, বিবাহ- বিচ্ছেদ প্রভৃতিও সামাজিক ঘটনা। ডুর্খেইমের মতে, সামাজিক ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণ সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। সেজন্য তিনি বলেন, সমাজবিজ্ঞান সামাজিক ঘটনাসমূহকে পাঠ করে।
ব্যক্তিজীবনে সামাজিক ঘটনাবলির প্রভাব আলোচনা করতে গিয়ে ডুর্খেইম সমাজকে প্রকৃতপক্ষে মানুষের নিয়ন্তা হিসেবে প্রতিপন্ন করেন। কারণ, সমাজে যা ঘটে, তা মানুষের চেষ্টার ফলে ঘটে না। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গকে সামাজিক ঘটনাকে মেনে নিতে হয় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে হয়। সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া থেকে সামাজিক ঘটনার সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিবিশেষের চিন্তা-ভাবনার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। সামাজিক ঘটনা কোন বিশেষ ব্যক্তির দিক থেকে বিচার করলে ‘বাহ্যিক বস্তু’। কিন্তু সামাজিক ঘটনা ব্যক্তিবিশেষের আচার-ব্যবহার ও ভাবনা-চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
ডুর্খেইম-এর মতে, জাগতিক ঘটনাবলি সম্বন্ধে মানুষের বিভিন্ন রকম চিন্তা যেমন- কাল (time), স্থান সংক্রান্ত ধারণা (Space), শ্রেণি (Class), সংখ্যা (Number) ইত্যাদি সবকিছু সমাজজীবন থেকে উদ্ভূত। ‘কাল’ বলতে সমাজজীবনের পুনঃসংগঠনশীল ঘটনাসমূহের চিহ্নিতকরণ (“Time is the collective representation of the rhythm of social life.”)। সমাজজীবনের প্রয়োজনে মহাকালকে দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর প্রভৃতি অংশে চিহ্নিত করা হয়। অনুরূপভাবে Space বা স্থান সংক্রান্ত ধারণাও সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভত। উদাহরণ হিসেবে তিনি অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকার কয়েকটি সমাজের উল্লেখ করেন। এসব সমাজে স্থানকে বৃহদায়তন গোলাকার বস্তু হিসেবে ভাবা হয়। কারণ তাদের শিবির ছিল গোলাকার এবং শিবিরের আকৃতি থেকে তাদের স্থান সম্বন্ধে ধারণা জন্মায়। এসব উদাহরণের সাহায্যে ডুর্খেইম প্রতিপাদন করতে চেয়েছেন যে, সমাজজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন রকম চিন্তার উদ্ভব হয়, কেবল অভিজ্ঞতা বর্জিত বিচার-বুদ্ধি নয়। একবার মনে গ্রথিত হয়ে গেলে এদেরকে বিচার-বুদ্ধি সঞ্জাত বলে প্রতীয়মান হয়। (পরিমল ভূষণ কর: সমাজতত্ত্ব : ১৯৯২ : ৬১ থেকে উদ্ধৃত)।
(“Durkheim argues quite cogently that the most fundamental categories of thought e. g. time, space, class, number, cause, substance, personality, force, etc. are ultimately derived from the conditions of men’s social existence, the cognitive structure of men’s minds is determined by the structure of their society. Time, for example, was the collective representation of the rhythm of social life The division into days, weeks, months. years etc. Similarly with space, “There are societies in Australia and North America where space is conceived in the form of an immense circle because the camp has a circular form and this special circle is divided up exactly like the tribal circle, and is in its image. Hence the categories of thought are not a ‘priori’ but derived from the structure of social existence; once implemented in men’s minds, the categories do indeed appear as if they were immanent.” (Zeitlin, Irving. M. Ideology and the Development of Sociological Theory. 1968: 277)
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায়, ডুর্খেইম বলতে চেয়েছেন, যদি সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজ পাঠে সামাজিক ঘটনাকে বস্তু বা পদার্থ হিসেবে গ্রহণ না করে কেবল সামাজিক সম্পর্কের বিষয়টি পাঠ করে তাহলে সমাজবিজ্ঞান তার পূর্বের স্থানেই ফিরে যাবে অর্থাৎ তা নিছক কল্পনা বিলাস দার্শনিক তত্ত্বরূপে পরিণত হবে।
সামাজিক ঘটনাসমূহকে ব্যক্তি বহির্ভূত বস্তু হিসেবে বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও ডুর্খেইম ধারণা করেছেন যে, মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে এদের জানা দরকার। কারণ ব্যক্তিকে তার যৌথ প্রতিরূপের অনুরূপ আচার-আচরণ ও কর্ম অনুসরণ করতে হয়। তাই এদেরকে এরূপ একটি সামাজিক অনুমোদিত আচরণ বলে গণ্য করা যেতে পারে, যা প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট থেকে আশা করা যায়।
অনেকের মতে, ডুর্খেইমের যৌথ প্রতিরূপ সংক্রান্ত প্রত্যয় ও সামাজিক ঘটনা সংজ্ঞার অর্থ শুধু ব্যক্তিসত্তার অস্বীকৃতি। আর এভাবে ব্যক্তিসত্তার অস্বীকৃতির মাধ্যমে মানুষের সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তি চিরতরে লোপ পাবে। ডুর্খেইম কিন্তু এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। উপরন্তু, তিনি দাবি করেছেন যে, ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তাকে একমাত্র তার যৌথ প্রতিরূপের মাধ্যমেই জানা সম্ভব। কেননা শ্রমবিভাগ ও সহযোগিতার মাধ্যমে সমাজে যে পরিবর্তন সূচিত হয় তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন সমাজের যৌথ প্রতিরূপের মধ্যে ঘটে। (মূল জর্জ সিমসন: অনুবাদ: ড. রঙ্গলাল সেন: ১৯৮৪ : ৯২)।
শেষ কথা
আজ আমরা এমিল ডুর্খেইম সামাজিক ঘটনা তত্ত্ব সম্পর্কে জানলাম। এটি তোমাদের অনেক উপকারে আসবে। পরীক্ষার জন্য ভালো করে পড়ে নিবেন।