কার্ল মার্কস
যেসব দার্শনিক তাত্ত্বিক আলোচনার দ্বারা মানুষের চিন্তা ও কর্মজগতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন, কার্ল মার্কস তাদের অন্যতম। চিন্তাজগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনকারী মার্কস ছিলেন একজন দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী।
মার্কস শুধু তাত্ত্বিক ছিলেন না, তিনি স্বয়ং বহু শ্রমিক আন্দোলনের অংশীদার ছিলেন। মার্কসকে পৃথিবীর বৃহত্তম গণ-আন্দোলনের প্রেরণাদাতা বলে গণ্য করা যায়। তিনি তাঁর তত্ত্ব ও প্রথম আন্তর্জাতিক (First international) সংস্থার মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণমুক্তির আন্দোলনে শামিল করার জন্য প্রয়াসী হন।
কার্ল মার্কস দর্শনের ছাত্র ছিলেন। তাঁর রচনায় হেগেলের (Hegel) দ্বন্দ্ববাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। জার্মান বস্তুবাদী দার্শনিক ফয়েরবাখের (Feurbach) দর্শন দ্বারাও প্রভাবিত হন। বস্তুত ফয়েরবাখ ও হেগেলের জ্ঞানতত্ত্ব অনুসরণে মার্কস ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তবাদ’ ও ‘ঐতিহাসিক বস্তবাদের’ তত্ত্বকে বিকশিত করেন। বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মার্কসীয় চিন্তা-চেতনা সক্রিয় রাজনীতিতে প্রতিফলিত হওয়ায় তাঁর দার্শনিক চিন্তা রাজনৈতিক আবিলতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বিংশ শতাব্দীতে সমাজ-ভাবনা মার্কসীয় চিন্তা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। মার্কস সামাজিক অভিব্যক্তি ব্যাখ্যা করে যে সূত্র উদ্ভাবন করেন তা সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার দিগন্ত নানাভাবে সম্প্রসারিত করেছে।
রেমন্ড অ্যারন (Raymond Aron) অনুসরণে বলা যায়, মার্কসের সমস্ত রচনাবলিকে দু’টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। ১৮৪১ সাল থেকে ১৮৪৮ সালের মধ্যে মার্কসের রচনাবলিকে তাঁর যৌবনকালের বা প্রথম জীবনের রচনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
আরও পড়ুন: ম্যাক্স ওয়েবার: তত্ত্ব, পরিচয় ও বিখ্যাত গ্রন্থ সমূহ
১৮৪১-১৮৪৮ সালের মধ্যে রচিত ‘দি হোলি ফ্যামিলি’ (The Holy Family), ‘দি পভার্টি’ অব ফিলোসফি’ (The Poverty of Philosophy), ‘দি জার্মান আইডিওলজি’ (The German Ideology), কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (Communist Manifesto) ইত্যাদির সাথে তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনা যথা: ‘এ কনট্রিবিউশন টু দি ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’ (A Contribution to the Critique of Political Economy), ‘দি ক্যাপিটাল (The Capital) ইত্যাদির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে।
মার্কসের দ্বিতীয় পর্যায়ের লেখাগুলো থেকে প্রতীয়মান হয়, তিনি হেগেলীয় ইতিহাসবাদের দিক থেকে ক্রমশ সরে এসে বিকাশমান সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক মতবাদের প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট ও মনোযোগী হয়েছিলেন। অর্থাৎ আমরা দার্শনিক মার্কসের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করি। সেজন্য রেমন্ড অ্যারন বলেন, “It might be said that from 1848 until the end of his life, Marx apparently ceased to be a philosopher and became a sociologist and, above all, an economist.” এ উক্তির বাংলা ভাবানুবাদ হচ্ছে- “দৃঢ়তার সাথে বলা যায় যে, ১৮৪৮ সালের পর থেকে জীবনের অন্তিমকাল পর্যন্ত স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, মার্কস দর্শন থেকে সরে এসে একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং সর্বোপরি একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবেও।”