ক্ষমতা
ক্ষমতা হচ্ছে মানবসমাজের একটি মৌলিক সত্তা। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে অদ্যাবধি মানবসমাজের প্রতিটি স্তরেই এর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ক্ষমতা চায় না এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিরল। কেননা ক্ষমতার কারণেই কেউ সম্মান, মর্যাদা ও খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করে, আবার ক্ষমতার মোহে কেউ অন্ধ হয়ে অন্যায়, অবিচার আর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে সমাজে হয় নিন্দিত। বস্তুত সামাজিক চালিকাশক্তির পিছনে কাজ করছে ক্ষমতার প্রয়োগ।
সাধারণ অর্থে, কাজ করার সামর্থ্যকে Power বা শক্তি বলা হয়। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা যায়, মানবীয় পরিসরে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রাধান্য হচ্ছে ক্ষমতা। অর্থাৎ সামাজিক জীবনে কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীসমূহের উপর প্রভাব বা আধিপত্য বিস্তার করাকেই ক্ষমতা বলা হয়।
আরও দেখুন: সাম্য কি | সাম্য কাকে বলে | সাম্যের সংজ্ঞা দাও
Max Weber ক্ষমতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “Power is the ability to control the behaviour of others even in the absence of their consent.”১” অর্থাৎ, ক্ষমতা হলো অপরের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য তাতে তাদের সম্মতি নাও থাকতে পারে। David Popenoe এর মতে, “Power is the capacity of people or
groups to control or influence the actions of these whether, those others with to cooperate or not. “১১ অর্থাৎ, ক্ষমতা হচ্ছে কোন লোক বা গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করার যোগ্যতা, তাতে ঐ লোক বা গোষ্ঠী সহযোগিতা করতেও পারে, নাও করতে পারে।
Kingsley Davis এর মতে, “Power is defined as the determination of the behaviour of others in accordance with one’s own ends. “১২ অর্থাৎ, ক্ষমতা হচ্ছে কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে অপরের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা।
Smelser এর ভাষায়, “Power is the ability to impose one’s will on others and the ability to mobilize resource to achieve a goal.” অর্থাৎ, ক্ষমতা হলো এমন সামর্থ্য যা কারো ইচ্ছা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়া যায় এবং সম্পদকে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কাজে লাগানো যায়।
Arnold Green এর মতে, “Power is simply the extent of capability to control others so that they will do what they are wanted to do. “১” অর্থাৎ, ক্ষমতা হচ্ছে নিতান্তই অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য যাতে তারা যা চায় তা সম্পাদন করতে পারে।
R. T. Schaefer এর মতানুযায়ী, যে কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার তিনটি মৌল উৎস রয়েছে। যথা:
Force, Influence, Authority।
অতএব বলা যায়, ক্ষমতা একটি বিমূর্ত ধারণা এবং সর্বজনীন প্রপঞ্চ। এটি হলো এমন এক ধরনের শক্তি, সামর্থ্য বা যোগ্যতা যার গুণে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যান্যদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নির্দিষ্ট গন্তব্যে পরিচালিত করে।
ক্ষমতার শ্রেণিবিভাগ
ক. ল্যুন্ডবার্গ (Lundberg) এবং অন্যান্যরা ক্ষমতাকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। যথা:
১. দমনমূলক ক্ষমতা (Coercive Power): এটি হলো এমন এক ধরনের ক্ষমতা যেখানে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করতে বল প্রয়োগের প্রয়োজন হয়।
২. উপযোগিতামূলক ক্ষমতা (Utilitarian Power): কোন যোগ্য ব্যক্তিকে তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ যখন কোন পুরস্কার প্রদান করা হয় তাকে উপযোগিতামূলক ক্ষমতা বলে।
৩. আত্মপরিচয়মূলক ক্ষমতা (Identitive Power): এটি হলো এমন এক ধরনের ক্ষমতা যেখানে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন নেই বরং অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে বিভিন্ন লোক একত্রিত হয়ে গঠনমূলক ও গ্রহণযোগ্য ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
আরও দেখুন: সাম্য কত প্রকার ও কি কি? – বিস্তারিত আলোচনা
খ. প্রভাবের দিক থেকে ক্ষমতাকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা:
১. শক্তি (Force): বল প্রয়োগের মাধ্যমে যার প্রকাশ ঘটে সেটি হচ্ছে শক্তি। অর্থাৎ শক্তি ক্ষমতাকে প্রকাশ করে। যেমন- কোন মুষ্টিযোদ্ধা যখন অন্যের সাথে লড়াই করে তখন তার ক্ষমতা সে প্রয়োগ করে।
২. আধিপত্য (Domination): আধিপত্য বিষয়টি ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটি একটি ব্যক্তিগত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য। যেমন- কোন ছাত্রছাত্রীদের উপর শিক্ষক যে প্রভাব বিস্তার করে তা এক ধরনের ক্ষমতা।
৩ . চাতুর্যপূর্ণ উদ্দেশ্য সাধন (Manipulation): যখন কোন কৌশল বা ছল-চাতুরীর মাধ্যমে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে তখন এটি এক ধরনের ক্ষমতা। যেমন- প্রচারণা বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অন্যের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা।
গ. ম্যাক্স ওয়েবার আইনের দৃষ্টিতে ক্ষমতাকে নিম্নোক্তভাবে বিভাজন করেছেন:
১. বৈধ ক্ষমতা (Legitimate Power): বৈধ ক্ষমতাকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
i. ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্ব (Traditional Power): সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা পদ্ধতি তথা ঐতিহ্যের বৈধতার স্বীকৃতির ভিত্তিতেই এ ধরনের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত।
ii. সম্মোহনী ক্ষমতা (Charismatic Power): কোন ব্যক্তি যখন তার নিজস্ব গুণাবলির ভিত্তিতে অন্যের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করেন তখন তা হলো সম্মোহনী ক্ষমতা।
iii. আইনানুগ ক্ষমতা (Legal Power): সংবিধান বা আইন অনুযায়ী যখন কোন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে আইনানুগ ক্ষমতা বলে।
২. অবৈধ ক্ষমতা (Illegitimate Power): সংবিধান ও আইন বহির্ভূতভাবে যে ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় তাকে অবৈধ ক্ষমতা বলে।
ঘ. রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী ক্ষমতা তিন ধরনের। যথা:
১. কর্তৃত্বব্যঞ্জক ক্ষমতা (Authoritarian Power): যখন কোন ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে তখন তাকে কর্তৃত্বব্যঞ্জক ক্ষমতা বলে।
২. গণতান্ত্রিক ক্ষমতা (Democratic Power): যে ক্ষমতার উৎস জনগণ তাকে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা বলে।
৩. সর্বাত্মক ক্ষমতা (Totalitarian Power): যখন ক্ষমতা কোন এক দল লোকের হাতে ন্যস্ত থাকে তখন তাকে সর্বাত্মক ক্ষমতা বলে।