জুম চাষ কি?
অনুন্নত কৃষিকাজের এক বিশেষ পদ্ধতির ইংরেজি নাম Shifting Cultivation যাকে বাংলায় আমরা পালাক্রম চাষ বা জুম চাষ বলে অভিহিত করে থাকি। জুম চাষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়-
Shifting Cultivation is a specialized technique of undeveloped agriculture. The Bengali term of ‘Shifting Cultivation is ‘Jume’, ‘এ পদ্ধতিকে ‘Slash and burn’ (কাটো–আর–পোড়াও) এবং ‘Swidden Cultivation’ নামেও আখ্যা দেয়া হয়। বর্তমানে অবশ্য ‘Swidden Cultivation’ নামটিই অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এ পদ্ধতিতে যখন কয়েক বছর ফসলদানের পর ফলনের হার হ্রাস পায়, তখন সে জমিটিকে তখনকার মতো ফেলে রেখে অন্য একটি জমিতে চাষ করা হয়। পরবর্তীকালে স্থানান্তরী কৃষিকর্মের প্রয়োজনে নিত্যনতুন জমির যোগান অসম্ভব দেখে ফসল তোলার পর শস্যের পড়ে থাকা গোড়াগুলো পুড়িয়ে দিয়ে প্রথম সার দেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। ক্রমশ উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ও সারের ব্যবহারে স্থানান্তরী কৃষিকর্ম উঠে যায়। তবে কোথাও কোথাও আদিবাসীদের মধ্যে এ প্রথা এখনো চালু আছে। যেমন– মালয় দ্বীপপুঞ্জে নিরক্ষীয় বনভূমি পরিষ্কার করে এভাবে কৃষিকর্ম চালানো হয়।
জুম চাষ হয় কোথায়?
রাঙামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি জেলার ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ পালাক্রম চাষ বা জুম চাষের উপর নির্ভরশীল।
জুম চাষ কিভাবে করা হয়?
পাহাড়শীর্ষে ঢালু জায়গায় সাধারণত জুম পদ্ধতিতে চাষ হয়। পাহাড়ের কতকাংশের গাছপালা কেটে ও আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর গর্ত করে এক সাথে ধান, মরিচ, লাউ, কুমড়া, তিল, তিসি প্রভৃতির বীজ বপন করা হয়। তারপর বছরের বিভিন্ন সময়ে যে ফসল আগে আসে সেটা কেটে ঘরে তোলা হয় ।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা
জুম চাষ কৌশল বা পদ্ধতি
১. জুম জমি নির্বাচন,
২. জমি পরিষ্কারকরণ,
৩. পতিত ঝোপ–ঝাড় পোড়ানো,
৪. বীজ বপন,
৫. বেড়া প্রদান এবং পাহারা দান ও
৬. ফসল কাটা।
জুম চাষ প্রায় বছর মেয়াদি এক উৎপাদন কার্যক্রম। পার্বত্য বাংলাদেশের সব ট্রাইবই প্রায় একই পদ্ধতিতে জুম চাষ করে। বস্তুত জুম চাষ অধিকাংশ পাহাড়ি ট্রাইবালদের ঐতিহ্যবাহী অর্থনীতি ।
আদিম অর্থনীতি কি?
সাধারণত আদিম অর্থনীতি বলতে বুঝায় আদিম সমাজের উৎপাদন, খাদ্য আহরণ, ভোগ ও বণ্টনের পদ্ধতির কথা। অন্যভাবে বলা যায় যে, আদিম সমাজের জীবিকানির্বাহের পদ্ধতি আদিম অর্থনীতি। আদিম সমাজে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন ছিল কর্ম, খাদ্য, আশ্রয় ও বস্ত্র। এসব উপকরণ আদিম মানুষের অর্থনীতির মূল লক্ষ্য ছিল। কারণ এগুলো দ্বারাই তারা কোন রকমে তাদের জীবন টিকিয়ে রাখতো।
আদিম অর্থনীতি সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে ড. অনাদি কুমার মহাপাত্র বলেন, “প্রাচীন কালে পশু শিকার, ফল–মূল সংগ্রহ প্রভৃতি ছিল আদিম মানুষের অর্থনীতির কর্মপ্রচেষ্টা।” আদিম মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ বা দলবদ্ধভাবে খাদ্য সংগ্রহ, বণ্টন ও ভোগ করতো। অর্থাৎ তখন ছিল সামষ্টিক শ্রম, সামষ্টিক ভোগ (Collective labour. Collective consumption)। আদিম সমাজের অর্থব্যবস্থাকে বুঝাতে গিয়ে ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানী মিনু মাসানী তাঁর ‘Our Growing Human Family’ আছে বলেন, “Life was either a feast or a fast. ” আদিম সমাজে জীবন ছিল ভূরভোজ নচেৎ উপবাস। তাঁর ভাষায়, আদিম সমাজে আর্থিক জীবন ছিল ‘From hand to mouth” অর্থাৎ, দিন আনে দিন খায় অবস্থায়। এজন্য সমাজতাত্ত্বিকরা আদিম অর্থনীতিকে জীবনধারণ অর্থনীতিও বলে থাকেন।
আদিম বা অনক্ষর সমাজের মানুষের সাথে আদিম অর্থনীতির এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ বয়স অনুপাতে কাজ করতো। তাদের উৎপাদন পদ্ধতি ছিল প্রকৃতিগত। তারা যেসব বস্তু সামনে পেত কিংবা দেখতো তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করতো। মেয়েরা ঘরে বসে রান্না করতো এবং বয়স্করা শিকার করতো। সবাই মিলে খাদ্য সংগ্রহ করে সমান ভাগে ভাগ করে খেত। মেয়েদের প্রধান অর্থনৈতিক কাজ ছিল শাক সবজি সংগ্রহ করা এবং এগুলো বসতির সামনে উৎপাদন করা। পুরুষেরা পশু শিকারের জন্য জঙ্গলে, গাছের ঝোপে, পাহাড় দিন রাত কাটাতো। তারা পশুর চামড়া দিয়ে বস্ত্র তৈরি করতো। আদিম সমাজে মেয়েরাই প্রথম মাটির বাসন, বালির বালতি ইত্যাদি আবিষ্কার করে।
আদিম সমাজ কি?
আদিম বা অশিক্ষিত সমাজ বলতে আমরা বুঝি যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের সমাজ। তাদের কোন লিখিত ভাষা ছিল না। দেখা গেছে যে, অন্যান্য সম্প্রদায়ের লিখিত ভাষা কিংবা অক্ষর আবিষ্কার হওয়ার পরও এসব অশিক্ষিত সমাজে লিখিত লিখিত ভাষা বা অক্ষরের আবিষ্কার হয়নি। আদিম মানুষের সামাজিক রীতিনীতি, আচার–বিধি ও চিন্তাধারা সভ্য মানুষের মতো নয়। তার জন্য সময়ের ব্যবধান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ইত্যাদি নানা কারণ দায়ী; অধিকন্তু এ বিভিন্নতা মানবজাতির ইতিহাসে এক এক স্তরের এক একটা ব্যবস্থা মাত্র। যতদিন পর্যন্ত মানুষের লিখিত ভাষা আবিষ্কার হয়নি, ততদিন মানুষ প্রকৃতির সাথে নিজেকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে নিয়োজিত ছিল। সেজন্য লিখিত ভাষা আবিষ্কার হওয়ার পূর্বের লোকদের বলা হতো অশিক্ষিত এবং এদের সমাজকে বলা হয়ে থাকে অশিক্ষিত সমাজ। কিন্তু লিখিত অক্ষর ও ভাষা আবিষ্কার হওয়ার পরও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এ অশিক্ষিত সমাজ রয়ে গেছে। এজন্য আমরা বলতে পারি– সব অশিক্ষিত সমাজ প্রাচীন নয়, তবে সবগুলো প্রাচীন সমাজই অশিক্ষিত।
আরও পড়ুন: জ্ঞাতি সম্পর্কের গুরুত্ব
এ অশিক্ষিত সমাজ বয়ে যাওয়ার মধ্যে বিশেষ কতকগুলো কারণ নিহিত রয়েছে। আমরা জানি, মানুষের সমাজ পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, তবে আদিম মানুষের ছিটেফোঁটা আচার–বিধি ও রীতিনীতির কোথাও একটু বা পরিবর্তিত হয়ে, কোথাও বা পূর্বের অবস্থায় এখনো বিশ্বের কোন কোন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ।
সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদগণ মনে করেন, মানুষ প্রথমে বনে–জঙ্গলে বা পাহাড়– পর্বতের গুহায় বাস করতো। তাদের জীবন ছিল যাযাবরের ন্যায়। ক্রমে ক্রমে তারা নিজেদের ভালোমন্দ বুঝতে শিখলো এবং একত্রে বসবাস করতে আরম্ভ করলো। এভাবে মানুষের আদিম সমাজ গড়ে উঠেছে। এ আদিম সমাজ গঠন সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। একদল সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, আদিকালে মানুষ ছোট ছোট পরিবারে বিভক্ত হয়ে বাস করতো, পরে তারা একত্রিত হয়ে এক একটি গোষ্ঠী বা উপজাতি গঠন করে। আবার অপর একদল সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, মানুষ প্রথমেই গোষ্ঠী বা উপজাতি গঠন করে বসবাস করতে থাকে। পরে তারা ছোট ছোট পরিবারে বিভক্ত হয়ে যায়।