ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা
ইউরোপে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার সূত্রপাত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ধনতন্ত্র এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে বেসরকারি মালিকানায় মানুষের তৈরি মূলধন ও প্রকৃতি প্রদত্ত মূলধন বেসরকারি মুনাফা আহরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এ ব্যবস্থাকে স্বাধীন বেসরকারি পুঁজি ব্যবস্থাও বলা হয়। এ ব্যবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত এবং সরকারি মালিকানা সীমিত। দেশের প্রত্যেক ব্যক্তি উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায়।
সুতরাং যে অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণগুলোর ব্যক্তিগত মালিকানা বিদ্যমান এবং সরকারি হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে অবাধ দাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজার পরিচালিত হয়, সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বলা হয়।
মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা গুলো কি কি? – ব্যাখ্যা কর |
ধনতন্ত্র সম্পর্কে ভি, আই, লেনিন (V. I. Lenin) বলেন, “ধনতন্ত্র বলতে উৎপাদনের ওই উন্নত স্তরকে বোঝায় যেখানে মনুষ্য শ্রমের উৎপাদন শুধু নয়, মনুষ্য শ্রমশক্তি নিজেই পণ্যে পরিণত হয়।” (By capitalism is meant that stage of development of commodity production at which not only the products of human labour, but human labour power itself becomes a commodity.)
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সমূহ
অধ্যাপক জে. এফ. র্যাগান (J. F. Ragan) ও এল. বি. থমাস (L. B. Thomas) বলেন, “বিশুদ্ধ ধনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হলো সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা এবং বাজারের ওপর আস্থা যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা সমবেতভাবে নির্ধারণ করে কী দামে কী পরিমাণ দ্রব্য ও সম্পদ বিক্রি হবে।” ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিচে বর্ণিত হলো-
১. ব্যক্তিগত মালিকানা
ধনতন্ত্রে ব্যক্তি শুধু যে ভোগ্যদ্রব্য নিজের মালিকানায় অর্জন করতে পারে, তা নয়; সে উৎপাদিত দ্রব্য নিজের মালিকানায় রাখতেও পারে। একজন ব্যক্তি বিশেষ দ্রব্যসমূহ অর্জন করতে এবং দ্রব্যসমূহ ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করতে যে অধিকার সমাজের নিকট হতে পায়, তাকে ব্যক্তিগত মালিকানা বলে।
২. ব্যক্তিগত উদ্যোগের স্বাধীনতা
ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদক নিজের ইচ্ছামতো পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারে। এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত উদ্যোগের সর্বাধিক স্বাধীনতা রয়েছে। নিজের অর্জিত অর্থ দিয়ে যেকোনো দ্রব্য ক্রয় ও ভোগ করতে পারে। শ্রমিক কাজ করবে না, বিশ্রাম নিবে বা কয় ঘণ্টা কাজ করবে ইত্যাদি সম্পূর্ণভাবে তার নিজের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। যারা বিভিন্ন পেশা অবলম্বন করতে চায়, তারা নিজেদের প্রতিভা বা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে পেশা নির্বাচন করতে পারে।
৩. উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন
ধনতন্ত্রে কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর সময় তার সম্পত্তি আত্মীয়স্বজনকে উইল করে প্রদান করার অধিকার ভোগ করে। আত্মীয়স্বজন হতে ধনসম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করার অধিকার এ ব্যবস্থায় আছে। উত্তরাধিকার ধনতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ। কারণ তা না থাকলে ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকারও থাকে না।
৪. স্বয়ংক্রিয় দামব্যবস্থা
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো স্বয়ংক্রিয় দামব্যবস্থা। দামব্যবস্থা এমন একটি অর্থনৈতিক পদ্ধতি যা ধনতান্ত্রিক সমাজের উৎপাদন, বিনিয়োগ, বণ্টন, ভোগ তথা সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে পরিচালিত করে। সরকার বা কোনো পরিকল্পনা বিভাগ দামব্যবস্থা পরিচালনা করে না। এক্ষেত্রে দ্রব্যের চাহিদা ও যোগানের ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ হয়।
৫. প্রতিযোগিতা
ধনতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অনেক ক্রেতা এবং অনেক-বিক্রেতার মধ্যে দরকষাকষি হয়। ক্রেতাসাধারণ নিম্নতম দামে দ্রব্য ক্রয় করতে চায় এবং বিক্রেতা উচ্চতম দামে দ্রব্য বিক্রয় করতে চায়। এভাবে ক্রেতা-বিক্রেতার সাথে অবাধ প্রতিযোগিতার ফলে দ্রব্যের দাম নির্ধারিত হয়।
৬. সম্পদের অসম বণ্টন
ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দেশের অধিকাংশ সম্পদের মালিকানা মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। ফলে দেশের অধিকাংশ জনসাধারণ অল্প পরিমাণ সম্পদ ভোগ করার সুযোগ লাভ করে। কাজেই ধনতন্ত্রে সম্পদের অসম বণ্টন পরিলক্ষিত হয়।
৭. মুনাফার উদ্দেশ্য
ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ফার্মের মূল লক্ষ্য মুনাফা সর্বোচ্চকরণ। ধনতন্ত্রের প্রাণ হলো মুনাফা। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে যে পার্থক্য থাকে বা ব্যয় হতে আয় যদি অধিক হয়, তাকে মুনাফা বলে। ধনতন্ত্রে পুঁজি বিনিয়োগকারী অধিক মুনাফা অর্জনের জন্যই যাবতীয় উৎপাদন করে থাকে। মুনাফা পুঁজি বিনিয়োগের উৎসাহ যোগায়। এজন্য উৎপাদনকারী ব্যয় যথাসম্ভব হ্রাস করে এবং আয় যথাসম্ভব বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করে।
৮. মূলধন রপ্তানি
ধনতন্ত্রে মূলধন রপ্তানির সুযোগ থাকে। ধনতান্ত্রিক দেশে পুঁজিপতিরা নিজ দেশে যখন বিনিয়োগের ক্ষেত্র পায় না, তখন তারা বিদেশে বিনিয়োগ করতে তৎপর হয়। পুঁজিপতিরা মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি করার জন্যই মূলধন রপ্তানি করে থাকে।
৯. শ্রেণি শোষণ
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে সমাজে শ্রেণিবিভক্তি দেখা দেয়। পুঁজিপতিরা এ সমাজে মুনাফা আহরণের উদ্দেশ্যে দ্রব্যের উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণ করে। ফলে শ্রমিকশ্রেণি শোষিত হতে থাকে এবং পুঁজিপতিরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে।
সুযোগ ব্যয় কি | সুযোগ ব্যয় কাকে বলে – চিত্রসহ ব্যাখ্যা |
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় কোনো পরিকল্পনা থাকে না। বেসরকারি মালিকানায় প্রধানত মুনাফার প্রতি লক্ষ রেখেই নিজস্ব পরিকল্পনায় দ্রব্য উৎপাদন করা হয়। দেশের উৎপাদন, বিনিয়োগ, বণ্টন, ভোগ প্রভৃতি পর্যায়সমূহ ব্যক্তিগত পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে আপনার ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা কাকে বলে ও ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারলেন। আশাকরি, এর মাধ্যমে আপনাদের জানার পরিধি অনেক বেড়ে গেলো।
1 comment
[…] […]
Comments are closed.