Home » নৃবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর

নৃবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর

by Rezaul Karim
নৃবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা

নৃবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

সাধারণভাবে যে কোন শাস্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে স্বচ্ছভাবে কোন চিত্র ফুটিয়ে তোলা কঠিন ব্যাপার। এক্ষেত্রে অনেক সময়েই বিশিষ্ট কোন লোকদের কোন শাস্ত্রের প্রণেতাবর্গরূপে চিহ্নিত করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করলে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তবে একথাও অনস্বীকার্য যে, কিছু কিছু প্রভাবশালী মনীষী আমাদের দৃষ্টিপথে এমনভাবে স্থান দখল করে থাকেন যাদের আমরা কোন শাস্ত্রের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানকারীরূপে গণ্য না করে পারি না।

নৃবিজ্ঞানের উৎপত্তিস্থান ইউরোপ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে নৃবিজ্ঞানের সুসংবদ্ধ অনুধাবন শুরু হয়। শিক্ষাক্ষেত্রেও নবাগত অধ্যায়। আধুনিক কালে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর মধ্যে নৃবিজ্ঞান নবীনতম হলেও এ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা সুদূর অতীতের বনিয়াদী বিভিন্ন মনীষীদের জ্ঞানচর্চাতেও পরিলক্ষিত হয়। পৃথিবী পরিক্রমায় ভূ-পৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকৃতির মানবগোষ্ঠী ইউরোপীয় দার্শনিকদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। মানবজাতির আকৃতি ও প্রকৃতিগত বিভিন্নতার উৎস সন্ধানের মাধ্যমে নৃবিজ্ঞান আলোচনার সূত্রপাত ঘটে।

টি. কে. পেন্নিম্যান (T. K. Penniman) তাঁর ‘Hundred Years of Anthropology’ গ্রন্থে নৃবিজ্ঞানের বিকাশকালকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করেন। ১৯৩৫ সালের পূর্বকাল পর্যন্ত ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি নৃবিজ্ঞানের বিকাশে বিভিন্ন উৎসের উপর গুরুত্বারোপ করেন। আমরা টি. কে. পেন্নিম্যানকে অনুসরণ করে নৃবিজ্ঞান বিকাশের একটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

১. প্রস্তুতি পর্ব- ১৮৩৫ এর পূর্বকাল ( Formulatory Period- before 1835),

২. বিষয়কেন্দ্রিক আলোচনা পর্ব- ১৮৩৫-১৮৫৯ (Convergent Period- 1835-1859),

৩. গঠনমূলক পর্ব- ১৮৫৯-১৯০০ (Constructure Period-1859- 1900),

৪. সমালোচনামূলক তাত্ত্বিক বিকাশ পর্ব (Critical Period-1901-1935)।

নিম্নে এই চারটি পর্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-

১. প্রস্তুতি পর্ব- ১৮৩৫ এর পূর্বকাল (Formulatory Period- before 1835)

ক) মানুষ সম্পর্কে মানুষের প্রকৃতিগত কৌতূহল: নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক জোসেফ ব্রাম বলেন, “পৃথিবীতে আবির্ভাবের দিন থেকে মানুষ যে শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে তা নয়, সে তার জীবনচর্চা প্রণালিকে নিয়ত পর্যবেক্ষণ করেও এসেছে। মানুষের এই স্বভাবজাত প্রকৃতি বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটে।

সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষ তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনের দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রথমে প্রাকৃতিক নিয়মাবলি সম্পর্কে জেনেছে এবং এসব নিয়মাবলিকে স্মৃতিতে ধরে রাখার ক্ষমতা যেহেতু মানুষের আছে তাই পরে সে এগুলোকে তাঁর চিন্তা এবং প্রকাশ ক্ষমতার দ্বারা অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে। মানুষের চিন্তা তিনটি পর্যায়ে বিদ্যমান থাকে; অংকুরিত বা সুপ্তচিন্তা, বিকাশমান চিন্তা এবং উৎকৃষ্টমানের বিকশিত চিন্তা। আর এই তিন পর্যায়ের চিন্তার মধ্যে সর্বদাই একটা পারস্পরিক ক্রিয়া চলতে থাকে।

খ) দার্শনিক ও সমাজচিন্তাবিদদের অবদান: আমেরিকার প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী ভোগেট মনে করেন, প্রাচীন গ্রিক ও রোমান পণ্ডিতেরাই ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল ইত্যাদির মতো নৃবিজ্ঞানেরও পথপ্রদর্শক। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে হেরোডোটাস (Herodotus) নামে এক মনীষীর পারস্য ও গ্রিসের যুদ্ধ বিবরণের মাধ্যমে আমরা বিজ্ঞানের স্বাক্ষর দেখতে পাই। এ যুদ্ধ বিবরণের মধ্যে সম্ভবত তৎকালীন পারস্য দেশের মানুষের জীবনযাত্রার বিচিত্র বিবরণ তুলে ধরা হয়। সেজন্য হেরোডোটাসকে নৃবিজ্ঞানের অন্যতম মহান পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয়।

সমাজ ও রাষ্ট্রের মৌলিক সমস্যা নির্ধারণে এরিস্টটলের প্রজ্ঞা অনেক ক্ষেত্রে তাঁর সমাজ ও কালকে অতিক্রম করে নৃবিজ্ঞানের সাধারণ স্বীকৃত সর্বজনীন সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। “মানুষ নিজেই যখন নিজের কাহিনী বলে; তখনই সে নৃবিজ্ঞানী।” এরিস্টটল এ অর্থেই নৃবিজ্ঞান শব্দটি প্রথম চয়ন করেন। এরিস্টটলের লেখার মধ্যেই মানুষ সম্পর্কে অনেক তথ্যের সন্ধান খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি মানুষের দৈহিক বিবরণ তুলে ধরেন সাংস্কৃতিক তারতম্যকে অনুধাবন করে। তিনি বলেন, উত্তরে অবস্থিত শীতপ্রধান ইউরোপীয় কর্মশক্তি প্রচুর, কিন্তু তাদের বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার অভাব; সুতরাং তারা স্বাধীন হলেও রাজনৈতিক সংগঠন ও সাম্রাজ্য বিস্তারে তাদের কোন যোগ্যতা নেই।

অন্যদিকে, দক্ষিণের গ্রীষ্মপ্রধান এশিয়াবাসী বুদ্ধিমান ও দক্ষ, কিন্তু তাদের কর্মশক্তির যথেষ্ট অভাব; তাঁর কালে তারা পরাধীন ও দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। কিন্তু উপযুক্ত দুই অঞ্চলের মাঝামাঝি এলাকায় বসবাসকারী গ্রিকগণ উভয় অঞ্চলের উত্তম গুণাবলির অধিকারী এবং সেজন্য তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। নৃতাত্ত্বিক ভূগোলের দৃষ্টিতে বলা যায়, মানুষ ও সমাজ সম্পর্কিত এরিস্টটলের এরূপ চিন্তা এখনো নৃতাত্ত্বিক গুরুত্ব বহন করে। আবার রোমান মনীষী ট্যাসিটাস (Tacitus-55- 120 AD) জার্মানির বিভিন্ন উপজাতির উপর এক তথ্যপূর্ণ বিবরণ লিখেছেন। তাঁর এ বিবরণ জাতিতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিল বলা যায় ।

অষ্টাদশ শতকে জার্মান ভাববাদী দার্শনিক কান্ট ১৭৮৯ সালে ‘Anthropology’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৬৫৫ সালেও নৃবিজ্ঞান শব্দটি একজন বেনামী লেখকের ইংরেজিতে প্রকাশিত ‘Anthropologic Abstruct’ এ মানব আত্মা ও মানব শরীর তত্ত্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এরূপ অনেকটা অস্পষ্ট ধারণার মধ্যে ১৮২২ সালে ব্রিটিশ এনসাইক্লোপেডিয়াতে নৃবিজ্ঞান শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর বার্গস ক্রোচে ডিলমে এবং হার্সেল এর দার্শনিক চিন্তাধারা প্রকৃতি বিজ্ঞান থেকে নৃবিজ্ঞানকে আলাদা করে তার সম্পর্কে নির্দিষ্ট ধারণা বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। স্কটল্যান্ডের নবজাগরণ ও ফার্গুসন এবং মনবাড়োয় সামাজিক বিকাশ এবং প্রাণী হিসেবে মানুষের উৎপত্তি সংক্রান্ত রচনাবলির মাধ্যমে সামাজিক চিন্তাধারাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।

মধ্যযুগের প্রারম্ভিককাল থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে অনেক মনীষী তাদের লেখনীর মাধ্যমে নৃতাত্ত্বিক ধারণার বীজ বপন করেছেন। ফ্রান্সিস বেকন (Francis Becon 1561-1626), রেনে দেকার্তে (Rene Decartes, 1596-1650), টমাস হবস (Thomas Hobbs 1588-1679), হার্বার্ট (Herbert 1508-1648), জন লক (John Locke 1632–1704), বেনিডিক্ট স্পাইনোজা (Benedict Spinoza 1632–1677), ভিকো (Vico 1668-1744), বেরেন ডি মন্টেস্কু (Baren de Montesqueeu 1689-1755), ভলতেয়ার (Voltaire 1694-1778) টারগট (Turgot 1727-1781), ডেভিড হিউম (David Hume 1711-1776), হেগেল (Hegel 1770-1831), কার্ল মার্কস (Karl Marx 1818-1883), এঙ্গেলস (Engels 1820–1895), সেন্ট সিমন ( Saint Simon 1760-1825) প্রমুখের নাম নৃবিজ্ঞান বিষয়ের তথ্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধ ।

এছাড়া ১৭৮২ সালে জে. সি. এডলাঙ্গ (G.C. Adelung 1732-1806) এর প্রকাশিত ‘History of the Culture of the Human Species’ গ্রন্থে মানব সংস্কৃতি বিকাশের আটটি পর্যায়ের যে বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন তা নৃতাত্ত্বিক গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টফ মেইনার্স (Christoph Mieners 1747-1810) তাঁর ‘History of Ethnological Theory’ নামক গ্রন্থে আদিম সমাজের প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের যে বিবরণ তুলে ধরেছেন তা নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান হিসেবে গুরুত্বারোপ করে।

গ) বিভিন্ন নাবিক, দূত, সেনাপতি ও পর্যটকদের অবদান: ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যেমন- প্রাচীন সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ কথা, লোক কাহিনী, দেশের কথা, দেশের লোকের কথা, সর্বশ্রেণির ও সর্বস্তরের লোকের জীবনযাত্রা ও ধ্যান- ধারণার আলোচনা মূল্যবান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়, নৃবিজ্ঞান অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যুগের কথা, যুগের চলার গতি, রীতিনীতি, আচার- ব্যবহার, বিধিব্যবস্থার কথা, যুগ থেকে যুগান্তরে যাত্রার উত্থান-পতন, এসবের কথা কেবল কল্পনা দিয়েই জানা যায়নি। অজানাকে জানার অদম্য আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ অভ্যস্ত জীবনযাত্রা থেকে বেরিয়ে পড়েছে বিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য। ফলে অনেক দুর্গম বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। তাদের অবদান যেমন ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে, তেমনি নৃবিজ্ঞান বিষয়ের তথ্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রেও মূল্যবান ভূমিকা রয়েছে। আমরা এখানে নৃবিজ্ঞান চর্চায় নাবিক, দূত, সেনাপতি ও পর্যটকদের প্রধান প্রধান অবদানের কথা উল্লেখ করছি।

গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের নৌ-সেনাপতি নিয়ার্কাস ( Nearcus), গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস, ইউরোপীয় পর্যটক মার্কো পোলো, চীনা পর্যটক ফাহিয়েন (Fa-Hian), ইউয়ান চোয়াং (Yuan Chawing (, আই সিং (I-sing), সুংউন (Sung Yung), হুয়ি সেং (Hwi-seng), গুরুং (O. Kung), ইবনে বতুতা ( Ibna – Batuta), রুশ পর্যটক নিকিটন (Nikiton), উইলিয়াম হকিন্স (Welliam Hawkins), স্যার টমাস রোঁ (Sir Thomas Roe), ফাঁসোয়া বার্নিয়ার (Franesise Bernier), তাভার্নিয়ের (Tavamier), ডা. ফ্রায়োর (Dr. Fryer), ওভিংটন (Ovington), জমেল্লী ক্যাবেরী (Gamelle), নিকোল্লাও মনচি (Neccolao and Monuce) প্রমুখ মনীষীদের নাম উল্লেখযোগ্য।

উপরোল্লিখিত পর্যটকদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে তৎকালীন সমাজ ও সংস্কৃতির একটি চিত্র ফুটে উঠে। তবুও বলা যায়, এ সকল তথ্য মানুষের দৈহিক নৃবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও ফলিত নৃবিজ্ঞানের গবেষণা ক্ষেত্রে মূল্যবান উপাদানের যোগান দেয়।

গ্রিক নৃপতি সেলিউকাসের দূতরূপে মেগাস্থিনিস প্রায় পাঁচ বছর (৩০২-২৯৮ খ্রিস্ট পূর্ব) সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভায় উপস্থিত ছিলেন এবং তৎকালীন ভারতের সমাজ ও শাসনব্যবস্থা, নগরীর সমৃদ্ধি, পথঘাট, প্রজাদের দৈনন্দিন জীবন, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা তাঁর ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। উল্লেখ্য যে, সেই গ্রন্থটির কোন অনুলিপি পাওয়া যায়নি। কিন্তু স্ট্র্যাবো, অরিয়ান, জাস্টিন প্রমুখ গ্রিক ও রোমান ঐতিহাসিকদের রচনায় তার বড় বড় উদ্ধৃতি পাওয়া যায়।
মেগাস্থিনিস ভারতের অধিবাসীদের দার্শনিক, কৃষক, পশুপালক ও শিকারি কারিগর, সৈনিক, নগর পরিদর্শক ও পৌর পালক এই সাত ভাগে ভাগ করেন।

মধ্যযুগে পর্যটকদের ভ্রমণ কাহিনী, নাবিকদের ভৌগোলিক আবিষ্কার, ধর্ম প্রচারক ও মিশনারিদের কর্মতৎপরতার মাধ্যমে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা কাজ আরো এগিয়ে নিয়ে যায়। তেরো শতকের শাসক পোপ গিয়োভিনী ডি প্লেনো কারগিনি (Giobinni de Plano Carpini 1182-1252 A.D.) নামক একজন কূটনীতিককে মঙ্গোলীয় সম্রাটের নিকট কূটনৈতিক মিশনের দায়িত্বে প্রেরণ করেন। মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্য থেকে ফিরে গিয়ে তিনি “History of Mongols’ নামে বিবরণ তুলে ধরেন। উইলিয়াম রুপোকুজ (Wiliam Rupruquis 1215-1323 A. D.) এশিয়া ভ্রমণ শেষে এদেশের বস্তুগত সংস্কৃতি এবং খাদ্যাভ্যাস, নারীদের কর্তব্য ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের উপর মনোরম বর্ণনা তুলে ধরেন।

পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দ্যা গামা (Vasco de Gama 1469-1528) ইউরোপ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে প্রথম জলপথে ভারতে আসেন। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে তিনি দক্ষিণ ভারতের কালিকট বন্দরে পৌঁছান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এদেশে বাণিজ্য স্থাপন করা।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৪৩-১৫০৬ খ্রিস্টাব্দ) যখন ১৪৯২ সালে বাহামা দ্বীপ, হাইতি, কিউবা এবং দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলভাগ আবিষ্কার করে তখন থেকে এই স্পেনের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য পত্তনের সূচনা। ঊনবিংশ শতাব্দীর এমন একজন উল্লেখযোগ্য পর্যটক হলেন এডলফ বস্তিয়ান (Adolf Bastian 1826-1905)। তিনি জাহাজের একজন ডাক্তার হিসেবে নিয়োজিত থেকে পৃথিবীর নানা সমাজের মানুষের সংস্পর্শে আসেন। তিনি ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট ছিলেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ধর্মীয় চিন্তার প্রকৃতির মধ্যে একই রূপ খুঁজে পান। তাঁর এই অভিজ্ঞতার আলোকেই ‘মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ঐক্যের তত্ত্ব’ তুলে ধরেন।

২. বিষয়কেন্দ্রিক আলোচনা পর্ব- ১৮৩৫-১৮৫৯

এই সময়কালের মধ্যে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মানুষের উৎপত্তির জীবতাত্ত্বিক এবং সামাজিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। যা পরবর্তীতে মানুষের সংস্কৃতির সূত্র হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এ সকল পণ্ডিতের মধ্যে কার্ল মার্কস (Karl Marx 1818-1883), চার্লস লিয়েল (Charls Lyell 1797-1895), উইলিয়াম স্মিথ (William Smith 1769-1839) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

মার্কসের পূর্বে নৃবিজ্ঞান সৃষ্টির যে প্রয়াস আমরা লক্ষ করেছি সেখানে সমসাময়িক কালের সমাজ সম্পর্কে এবং সমাজস্থ মানুষ সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্ৰহ করা হয়েছিল এবং অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রক্রিয়ার কোন কোন বিষয়ের উপর বর্ণনামূলক লেখাও সংগ্রহ করা হয়েছিল কিন্তু ইতিহাসের প্রক্রিয়া বিভিন্ন এবং পরস্পর বিরোধী বিকাশের যে প্রবণতা রয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করে তা থেকে একটি সামগ্রিক ধারা বের করার কোন প্রচেষ্টা সে সময়ে তাদের লেখায় আমরা দেখতে পাই না। মার্কস মনে করেন, অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বই সমাজের চালিকাশক্তি। সমাজের বিকাশ সে নিয়মেই এগিয়ে চলে।

ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ পার্থেজ (Perthes 1783-1883) একটি নদীর তীরবর্তী অঞ্চল হতে যখন কতকগুলো পাথরের হস্তকুঠার কুড়িয়ে পেল তখন সংস্কৃতির বিকাশকে প্রত্নতাত্ত্বিক বিকাশ বলেই মনে করলেন। এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অঞ্চল পরিদর্শন করে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ চার্লস লিয়েল কিছু নিদর্শন ব্রিটেনের রয়েল সোসাইটি এবং ব্রিটিশ একাডেমিতে উপহার হিসেবে প্রদান করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় থেকে পঞ্চম দশকে যখন মানুষ ও তার সংস্কৃতির বিকাশকে বিভিন্ন মনীষীগণ অর্থনৈতিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর গুরুত্বারোপ দেখছিল তখন চার্লস ডারউইন জীবতাত্ত্বিক (Charles Darwin 1809-1882) বিশ্লেষণে ‘বিবর্তনবাদ’ প্রচার করেন। তিনি ১৮৫৮ সালে তাঁর এই ‘বিবর্তন’ তত্ত্ব তুলে ধরেন এবং ১৮৫৯ সালে The Origin of Species’ নামক গ্রন্থে তা উল্লেখ করেন।

৩. গঠনমূলক পর্ব (১৮৫৯-১৯০০)

নৃবিজ্ঞানী পেন্নিম্যান এর মতে, ডারউইনের ‘Origin of Species’ প্রকাশের পর নৃবিজ্ঞানের বিষয়কেন্দ্রিক পর্বের অবসান ঘটে এবং গঠনমূলক পর্বের সূচনাকাল শুরু হয়, যা ১৯০০ সাল পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হয়। কেবল একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে নৃবিজ্ঞান পঠন-পাঠন এবং গবেষণায় ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন ১৮৮৪ সালে অক্সফোর্ড এবং ১৯০০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিতই হয়নি, বরং ই. বি. টেলর, জেমস ফ্রেজার, হেনরি মেইন, জে. এফ. ম্যাফলিনান, এডলফ বস্তিয়ান, এল. এইচ. মর্গানসহ অন্যান্য নৃবিজ্ঞানীদের বলিষ্ঠ ও মূল্যবান গবেষণা ও প্রকাশনার মাধ্যমে দ্রুতগতিতে বিকাশ লাভ করে বিশ্বজুড়ে নৃবিজ্ঞান স্বীকৃতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়কালে নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে জাতিতত্ত্ব, প্রাক-ইতিহাস, সামাজিক নৃবিজ্ঞান, ভৌত বা দৈহিক নৃবিজ্ঞান প্রভৃতি সৃষ্টি হয়।

নৃবিজ্ঞানের এই গঠনমূলক পর্বে নৃতাত্ত্বিক গবেষণার কার্যক্রম কেবল ইংল্যান্ড, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এমনকি ফ্রান্সে যখন এর কোন প্রতিষ্ঠা ছিল না তখন ইমাইল ডুরখেইম (১৮৫৬-১৯১৭) পল বিভেট, মার্সেল মশ, লেভী ক্ৰহেলো প্রমুখের সহযোগিতায় গোটা বিশ্বের সমাজব্যবস্থার নিরিখে আদিম সমাজ সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা ফ্রান্সে চালু করে নৃবিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ এর ভূমিকা পালন করেন। ফলে ফরাসিতে সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে।

আরও পড়ুন:   নৃবিজ্ঞান কি বা কাকে বলে? নৃবিজ্ঞান এর জনক কে?

১৮৯৮ সালে সমাজবিজ্ঞানের বিখ্যাত জার্নাল ‘L. Anne Sociologique’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতগণ নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন। আবার এ সময়েই ‘American Journal of Folklore’, ‘Bulletin of the Royal Anthropological Society of Great Britain Ireland (Now Known as Man’) চালু হয়। তাতে কেবল নৃতাত্ত্বিক বিষয়াদিই নয়, বরং ঔপনিবেশিক প্রশাসন ব্যবস্থার মুখপাত্র হিসেবে এর তাৎপর্য ফুটে উঠে। এরই ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণা কর্মের প্রসারণ ঘটে।

৪. সমালোচনামূলক তাত্ত্বিক বিকাশ পর্ব ১৯০০-১৯৩৫

নৃবিজ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে এ সময়টা অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী কাল। বহুমুখী গবেষণার ফলে মানুষ ও তাঁর সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের প্রসারতা ঘটে। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের মতো নৃবিজ্ঞানও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। কারণ এর বিভিন্ন অংশের ভিতর প্রচুর মতবিরোধ বিদ্যমান; যেমন- বর্ণ নিয়ে আগেও বিতর্ক ছিল, এখনো আছে। বর্ণের শ্রেণিবিভাগ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেশ মতবিরোধ লক্ষ করা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও ব্যাখ্যা দ্বারা নৃবিজ্ঞানে নতুন নতুন মতের সংযোজন হয়েছে; যেমন— সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে তিনটি মতবাদ গোষ্ঠী লক্ষ করা যায়; যথা: বিবর্তনবাদ, ব্যাপ্তিবাদ এবং ক্রিয়াবাদ। এছাড়া বিজ্ঞান সমাজের বাস্তব সমস্যা সমাধানে কতটুকু কার্যকর সে সম্বন্ধেও নৃবিজ্ঞানীদের ভিতর মতানৈক্য রয়েছে। কিভাবে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে এবং কিভাবে বৃহত্তর মার্কিন সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করা যায় ইত্যাদি বিষয়ে নৃবিজ্ঞানীদের ভিতর নানা মত দেখা যায়।
নৃবিজ্ঞান গবেষণার ব্যাপকতার জন্য একদিকে যেমন নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিকাশ ঘটেছে তেমনি সর্বজনগ্রাহ্য ও সুপ্রতিষ্ঠিত কতক প্রত্যয়ও গড়ে উঠেছে।

ই. বি. টেইলর ও এল. এইচ. মর্গানকে আধুনিক নৃবিজ্ঞানের জন্মদাতা বলা হয়। এক্ষেত্রে হার্বার্ট স্পেন্সারের অবদানও কম নয়। টেইলর ও মর্গান উভয়েই বিবর্তনবাদী। তাঁরা মানবসমাজের বিকাশের স্তর নিয়ে গবেষণা করেছেন। সাংস্কৃতিক বিবর্তনমূলক প্রশ্নটি আজও নৃবিজ্ঞানের অন্যতম সমস্যা রূপে গণ্য। প্রত্যক্ষ অনুসন্ধান পরিচালন পদ্ধতির বিকাশ ও পরীক্ষিত জ্ঞানের ফলে এক সময়ে এর গুরুত্ব কমে গিয়েছিল সত্য, কিন্তু বর্তমানে আবার এ প্রশ্ন পুনরায় নতুনভাবে উত্থাপিত হচ্ছে। ফ্রান্স খোয়াস সুসংবদ্ধকারী নৃবিজ্ঞানী ছিলেন না কিন্তু তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাভিত্তিক গবেষণার উপর গুরুত্বারোপ করে বেশ কয়েক বছর যাবৎ নৃবিজ্ঞানের ছাত্রদের উপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছেন। ভাষাতত্ত্ব ও বর্ণ সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। আজ একথাও বলা হচ্ছে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের বিকাশ শুধু বিবর্তনবাদী মতবাদ থেকেই হয়নি, দূর-দূরান্তের বিভিন্ন সংস্কৃতির ভিতর পশ্চিমা শিক্ষিত লোকদের অনুপ্রবেশের ফলেই এর উন্নতি ঘটেছে। আবার মানুষের ব্যক্তিত্বের গড়ন ও তাঁর সাংস্কৃতিক নমুনার ভিতর যে সম্পর্ক রয়েছে সে সম্বন্ধে আন্তঃবিভাগীয় আলোচনার ব্যবস্থা হয়েছে। এ ধরনের আলোচনায় নৃবিজ্ঞান একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।

উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি, নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশের যে চারটি যুগ পর্বের বিভাগ নৃবিজ্ঞানী টি, কে. পেল্লিম্যান করেছেন তা সত্যিকার অর্থেই যথার্থ বিবরণ বলে আমরা মনে করতে পারি।

Related Posts