Home » পরিবারের কার্যাবলী আলোচনা কর

পরিবারের কার্যাবলী আলোচনা কর

by Rezaul Karim
পরিবারের কার্যাবলী আলোচনা কর

পরিবার একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। মানবসমাজের সুদীর্ঘ বিবর্তনের একটি রূপ আজের পরিবার। দেশ, জাতি ও পরিবেশভেদে বিভিন্ন ধরনের পরিবারের আবির্ভাব ঘটলেও পরিবারের দায়-দায়িত্ব তথা পরিবারের কার্যাবলী সব পরিবারেই কম-বেশি একই বলা যায়। আজ পরিবারের এসব কার্যাবলী সম্পর্কে আলোচনা করবো।

পরিবারের কার্যাবলী

পরিবার সমাজজীবনে এমন একটি স্থান অধিকার করে আছে যেখানে ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করে এবং মৃত্যু অবধি সেখানেই জীবন অতিবাহিত করে। এজন্য বিভিন্ন প্রকারের বহুবিধ কার্যসম্পাদনের মাধ্যমে পরিবার সমাজজীবনে বিদ্যমান।

আমরা দেখতে পাই যে, সমাজবিজ্ঞানীগণ সমাজকে জানার জন্য পরিবারের কার্যপ্রণালিকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে তুলে ধরেছেন; যেমনসমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পরিবারের কার্যাবলী গুলো নিম্নোক্ত ভাগে বিভক্ত করা যায়:

. জৈবিক বা জন্মদানমূলক কার্যাবলী (Biological functions)

. শিক্ষামূলক কার্যাবলী (Educational functions)

. অর্থনৈতিক কার্যাবলী (Economic functions)

. রাজনৈতিক কার্যাবলী (Political functions)

. মনস্তাত্ত্বিক কার্যাবলী (Psychological functions)

. আমোদপ্রমোদ কার্যাবলী (Recreational functions)

. সামাজিকীকরণ কার্যাবলী (Socialization functions) এবং

. ধর্মীয় কার্যাবলী (Religious functions)

. জৈবিক বা জন্মদানমূলক কার্যাবলী (Biological functions)

পরিবার যৌন সম্পর্ক দ্বারা গঠিত। নারী পুরুষের যৌনমিলনের উদ্দেশ্যে তাদেরকে পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে হয়। নারী পুরুষ পরিবার গঠন করলে তাতে তাদের যৌন তৃপ্তির যেমন সুবিধা হয়, তেমনি তারা বৈধভাবে সন্তানও জন্ম দিতে পারে। সুতরাং হিসেবে পরিবারকে সন্তান উৎপাদন লালনপালনকারী প্রতিষ্ঠানও বলা চলে। নারীপুরুষের জৈবিক ক্ষুধা পরিতৃপ্তির জন্য অনেক সময় সমাজে ব্যভিচারও হতে পারে। পরিবার গঠনের মাধ্যমে সমাজের শালীনতা রক্ষা হয় এবং আইন শৃঙ্খলার মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনের দ্বারা একত্রিত হয়ে মানবজাতির যাত্রার স্থায়িত্ব বিধান করে। যদিও অনেকে মনে করেন যে, জৈবিক ক্ষুধা পরিতৃপ্তির জন্য পরিবার গঠনে ততটা গুরুত্বারোপ করে না, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে নিজের বংশ মানবজাতির ধারাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সামাজিক আইন কাঠামোর ভিত্তিতে পরিবার গঠন করতে হয় এবং তা একমাত্র জৈবিক ক্ষুধা পরিতৃপ্তির মাধ্যমেই সম্ভব।

যদিও দেখা যাচ্ছে যে, বর্তমানে শিল্পোন্নত সমাজে মানুষ অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে জৈবিক ক্ষুধা মিটিয়ে থাকে, কিন্তু এটি সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এবং সমাজে যৌন অনাচার অন্যান্য অপরাধ সৃষ্টি করে। তাকে সমাজের শালীনতার অঙ্গহানিকর বলে মনে করতে পারি। সুতরাং সমাজকে সুন্দরভাবে এবং পরিকল্পিত উপায়ে টিকিয়ে রাখতে হলে একমাত্র পরিবারের মাধ্যমেই যৌন তৃপ্তির দ্বারা বংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এটা সমাজের ব্যভিচার অন্যান্য অপরাধ দূরীকরণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।

. শিক্ষামূলক কার্যাবলী (Educational functions)

পরিবার সমাজবদ্ধ মানুষের প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র। পরিবারেই সন্তানসন্ততিরা জীবনের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে। এজন্য পরিবারকে বলা হয় শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। পরিবার হতেই সন্তানসন্ততিরা গড়ে উঠে এবং তাদের জীবনের রূপ পারিবারিক রূপের বহিঃপ্রকাশ বলা চলে। পরিবারে সন্তানগণ যে শিক্ষালাভ করে তা তাদের অন্তরে চিরস্থায়ীভাবে দাগ কাটে এবং তাদের উপর প্রবল স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। পারিবারিক জীবনে তারা পরস্পর পরস্পরের আচারঅনুষ্ঠানের মাধ্যমে নম্রতা, ভদ্রতা, দয়ামায়া, প্রেমপ্রীতি, ভালোবাসা প্রভৃতি গুণগুলো শিক্ষালাভ করতে পারে। কেবল পল্লি সমাজে নয়, নগর সমাজের পরিবারেও এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। এছাড়া পরিবারের সুষ্ঠু পরিবেশে সন্তানসন্ততিরা তাদের মনোভাবকে আগামী জীবনের পরিকল্পনায় গড়ে নিতে সুযোগ পায়। সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, পরিবারই হলো শিক্ষা গ্রহণের প্রাণকেন্দ্র।

. অর্থনৈতিক কার্যাবলী (Economic functions)

জীবনধারণের জন্য আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ তৈরি করা পরিবারের আর একটি প্রধান কাজ। পূর্বে পরিবারই ছিল উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল। অনুন্নত কৃষিনির্ভর সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবার সম্পত্তির মালিক হয় তা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাচীন কালে মানুষের কার্যাবলির বেশিরভাগই পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরিবারে পুরুষেরা কৃষিকাজ বা ব্যবসায়বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাইরে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করতো এবং মেয়েরা ঘরে থেকে সংসারের তত্ত্বাবধান সন্তানসন্ততি লালন পালন করতো। স্ত্রীপুরুষের যৌথভাবে উপার্জিত অর্থ পরিবারের ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করতো।

বর্তমানে সময়ের বিবর্তনে অবস্থারও বিবর্তন ঘটেছে। উৎপাদনের যে কাজ পরিবারের দ্বারা হতো তা অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে নিয়েছে। পরিবারের সদস্য সেসব প্রতিষ্ঠানে বা সে স্থানে গিয়ে উৎপাদনে সহায়তা করে। ফলে জীবিকার জন্য পারিবারিক সম্পত্তির উপর নির্ভরশীলতা বহুল পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। বিশেষকরে, উন্নয়নশীল এবং উন্নয়নকামী দেশগুলোতে অবস্থা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলা যেতে পারে। কিন্তু এখনো অনেক অনুন্নত দেশ রয়েছে যেগুলো কৃষিনির্ভর, সেসব দেশগুলোতে আজও পরিবারের দ্বারা অর্থনৈতিক কার্যাবলি। প্রত্যক্ষভাবে হয়ে থাকে। আমরা আমাদের দেশ ভারতের কথাও বলতে পারি। যদিও আমাদের দেশে শিল্পের অগ্রগতি শিক্ষার প্রসারতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তবুও পরিবারের সম্পত্তির উপর নির্ভর করেই আর্থিক সচ্ছলতার কথা চিন্তা করতে পারি।

. রাজনৈতিক কার্যাবলী (Political functions)

পরিবারের সদস্যদেরকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা যেমন রয়েছে তেমনি আবার পরিবারের কর্তার কর্তৃত্বও রয়েছে অনেক। পরিবারের কর্তাকে রাষ্ট্রপ্রধানের সমতুল্য বলা চলে। পরিবারের মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা প্রবর্তন, পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা, সহনশীলতা, আলোচনা, পরামর্শ প্রভৃতি সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যগণ প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবার থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে। এর ফলে নাগরিকতার অধিকার কর্তব্য সম্বন্ধে প্রথম শিক্ষা পরিবারেই লাভ করে থাকে। এজন্য পরিবারকেনাগরিক গুণের প্রাথমিক শিক্ষাগারবলা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন:   পরিবারের উৎপত্তি সম্পর্কে মর্গানের তত্ত্ব

প্রাচীন রোমের প্যাট্রিয়ার্কের ভূমিকা লক্ষ করলে দেখা যায় যে, পরিবারই ছিল একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, যাতে পরিবারের কর্তার হাতে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বলবৎ ছিল। কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ফলে সে কর্তৃত্ব অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই যে, বর্তমানে অনেক পরিবারেই যুবকযুবতীরা তাদের ইচ্ছানুযায়ী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে এবং তা পরিবারের কর্তার স্বীকৃতির অপেক্ষা রাখে না।

. মনস্তাত্ত্বিক কার্যাবলী (Psychological functions)

একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, প্রত্যেক পরিবারেরই একটি মনস্তাত্ত্বিক ভূমিকা রয়েছে। পরিবারই হলো একমাত্র মানসিক যাতনা নিবারণের কেন্দ্রস্থল। পরিবার এক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ পরিবারস্থ লোকজন ছেলেমেয়ের জন্য পরিবার যথেষ্ট যত্ন নেয় এবং তাদের শারীরিক মানসিক উভয় দিক দিয়েই যত্ন নেয়। এছাড়া পরিবার ব্যক্তির সুষ্ঠু মানসিকতা গড়ে তুলতে বিশেষভাবে সহায়ক। পরিবারের মাঝে ব্যক্তির প্রেমপ্রীতি, মায়ামমতা, স্নেহভালোবাসা প্রভৃতি হৃদয়বৃত্তির উল্লেখ হয়।

. আমোদপ্রমোদ কার্যাবলী ( Recreational functions)

পরিবারে সদস্যগণ অবসর সময়ে বিভিন্ন প্রকার খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের কর্মজীবনের বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারে এবং জীবনের একঘেয়েমি ভাব দূর করতে পারে; যেমনছেলেমেয়েরা পরিবারে খেলাধুলা করে; বয়স্করা পরিবারে গল্পগুজব করে এবং সকলেই পরিবারে অবসর সময় কাটিয়ে থাকে।

. সামাজিকীকরণ কার্যাবলী (Socialization functions)

পরিবার সামাজিকতা শিক্ষা দেবার প্রধান কেন্দ্রস্থল। সমাজের সদস্য হয়ে চলার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রথমত পরিবার হতে আমরা লাভ করে থাকি। সামাজিক আচারআচরণ, রীতিনীতি, আদবকায়দা, মূল্যবোধ, ধর্ম, সংস্কৃতি প্রভৃতি সম্বন্ধে প্রাথমিক শিক্ষা আমরা পারিবারিক জীবনে লাভ করে থাকি। শিক্ষা আমাদের ব্যক্তিজীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে বাস্তব জীবনের শিক্ষা যা সমাজব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে নিজেকে সাহায্য করে।

. ধর্মীয় কার্যাবলী (Religious functions)

পরিবার যেমন প্রাথমিক শিক্ষার কেন্দ্রস্থল তেমনি পরিবার হতে পরিবারের সদস্যগণ ধর্মীয় শিক্ষালাভ করে থাকে; যেমনএকটি মুসলমান পরিবারের সদস্যগণকে তাদের পরিবারের নিয়ম প্রধানুযায়ী চলতে হয় এবং সমাজে সে পরিবারের পরিচয়ে পরিচিত এবং তাকে পরিবারের অন্য সদস্যদের ন্যায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। আবার তেমনি হিন্দু অন্যান্য পরিবারের সদস্যদেরও ঠিক এভাবে সমাজে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। নচেৎ পরিবারের সদস্যগণ একই বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারে না।

এছাড়াও আমরা দেখতে পাই যে, মুসলমান পরিবারের সদস্যগণ শৈশবকাল হতেই কুরআন শরীফ থেকে ধর্মের আইনকানুন শিক্ষালাভ করে থাকে এবং হিন্দু পরিবারের সদস্যগণ গীতা থেকে ধর্মশিক্ষা লাভ করে থাকে। পরিবার ধর্মীয় কার্যাবলি সম্পাদন করে বলেই সদস্যগণ একই ধর্মাবলম্বী হয়ে থাকে। যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়, তবুও ধর্মীয় কার্যাবলি পরিবারের অন্যান্য কার্যাবলির তুলনায় কম নয়

পরিবারের কার্যাবলী যদিও সময় সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে তথাপি পরিবারের গুরুত্ব কোনদিনই হ্রাস পাবে না। একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, সমাজের সকল সমস্যা পরিবার থেকেই উদ্ভব হয় এবং এর সমাধান একমাত্র পরিবারের কার্যাবলির মাধ্যমেই সম্ভবপর হতে পারে।

Related Posts