প্রিয় পাঠক, মুদ্রাস্ফীতি একটি দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই ভয়াবহ একটি ব্যাপার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। আজকে আমরা আলোচনা করবো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব সম্পর্কে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ক্রমাগত বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তথা মুদ্রাস্ফীতি রোধের জন্য সরকার নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও দেশে মুদ্রাস্ফীতির চাপ অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে ভূমিহীন কৃষক, বেকার, গরিব জনসাধারণ, মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী ও সীমিত আয়ের লোকদের পক্ষে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা খুবই কঠিন হয়ে গড়েছে। নিচে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. উৎপাদনের উপর প্রভাব
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। যেমন-
(ক) কৃষি: বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির ফলে কৃষি উপকরণের মূল্য যতখানি বৃদ্ধি পায় তার তুলনায় কৃষিপণ্যের মূল্য অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশে কৃষি উৎপাদনের উপর অনুকূল প্রভাব সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন কৃষক অপেক্ষা ধনী কৃষকরাই অধিক সুফল ভোগ করে থাকে।
(খ) শিল্প: বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির ফলে শিল্প উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণ দাম অপেক্ষা শিল্পে উৎপাদিত দ্রব্যাদির দাম অনেক বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেশের ধনী শিল্পপতিরা মুনাফা বৃদ্ধির মাধ্যমে আরও লাভবান হয়।
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণ কি কি – আলোচনা কর |
(গ) সেবা: বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির ফলে বিভিন্ন পেশাজীবী লোকদের উৎপাদিত সেবাকর্মের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে তারা বেশি করে সেবা প্রদানে আগ্রহী হয়েছে। বর্তমানে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে এই খাতের পরিমাণগত এবং গুণগতমান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
২. কর্মসংস্থানের উপর প্রভাব
দেশে বিদ্যমান অব্যবহৃত সম্পদ এবং অপূর্ণ নিয়োগ বা বেকারত্ব অবস্থায় মৃদু মুদ্রাস্ফীতি (mild inflation) কর্মসংস্থানের উপর অনুকূল প্রভাব বিস্তার করে। কারণ তখন দেশে দ্রব্যমূল্য ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ থেকে প্রত্যাশা বাড়ে। এ অবস্থায় দেশে ব্যাপকহারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি হওয়ার কথা এবং এর ফলে কর্মসংস্থানও যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তবে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, দুর্বল প্রশাসন ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ইত্যাদি কারণে যে পরিমাণ শিল্প কারখানার বৃদ্ধি হওয়া উচিত ছিল তা হয় নি । ফলে কর্মসংস্থানের আশানুরূপ বৃদ্ধি ঘটে নি।
৩. আয় ও সম্পদের বণ্টনের উপর প্রভাব
মুদ্রাস্ফীতির ফলে আয় ও সম্পদের বণ্টনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে থাকে, যা নিম্নরূপ:
(ক) সীমিত আয়ের লোক: মুদ্রাস্ফীতির ফলে সীমিত আয়ের লোকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ দামস্তর বাড়লে একই পরিমাণ মজুরি দ্বারা তারা পূর্বের চেয়ে কম পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে বাধ্য হয়। পেনশন ভোগীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের পেনশনের প্রকৃত মূল্য কমে যায়।
(খ) শ্রমিক শ্রেণি: দামস্তর বৃদ্ধির ফলে শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ দ্রব্য ও সেবার দাম বাড়লেও তাদের মজুরি আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায় না।
(গ) কৃষিজীবী: দামস্তর বৃদ্ধির ফলে কৃষিজীবী সম্প্রদায় লাভবান হয়। কারণ উৎপাদন ব্যয় মোটামুটিভাবে অপরিবর্তিত থাকলে যদি কৃষিজাত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়, তখন তারা লাভবান হয়।
(ঘ) ক্রেতা ও ভোগকারী: দামস্তর বৃদ্ধি পেলে ক্রেতা ও ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ তারা পূর্বের তুলনায় সমপরিমাণ অর্থ দ্বারা কম পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারে।
(ঙ) ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা: দামস্তর বৃদ্ধির ফলে ঋণগ্রহীতাদের ঋণভার হ্রাস পায় বলে তারা লাভবান হয়। তবে উক্ত ঋণ গ্রহীতা যদি উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে গৃহীত ঋণ ব্যয় করে তাহলেই সে অধিক লাভবান হবে। পক্ষান্তরে, দামস্তর বৃদ্ধির ফলে ঋণদাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা সে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দ্বারা পূর্বাপেক্ষা কম পণ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারে।
(চ) উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী: দামস্তর বৃদ্ধির ফলে উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়িগণ লাভবান হয়। কারণ দামস্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় না। ফলে উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
(ছ) করদাতা: দামস্তর বৃদ্ধির ফলে করদাতারা পূর্বাপেক্ষা কম দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করে কর পরিশোধ করতে পারে বলে করদাতা লাভবান হয়।
মুদ্রাস্ফীতির কারণ কি কি – আলোচনা কর |
(জ) মজুতদারি ও চোরাকারবার: প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুত এবং চোরাচালান করে আসছে। ফলে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়ে দেশে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে। সমাজের একশ্রেণির লোকের হাতে এরূপ কালো টাকার পাহাড় তৈরি হচ্ছে এবং তারা অনেকে আইন অমান্য কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। সাধারণ নিরীহ মানুষ কষ্ট স্বীকার করছে।
(ঝ) বৈদেশিক বাণিজ্য: মুদ্রাস্ফীতির ফলে দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হার হ্রাস এবং উৎপাদিত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কিন্তু আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ক্রমাগতভাবে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. সামাজিক প্রভাব (Social Effect)
সামাজিক জীবনেও মুদ্রাস্ফীতির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ধনী ও দরিদ্রদের মাঝে আয়-বৈষম্য ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ধনী আরো ধনী হচ্ছে গরিব হতদরিদ্রে পরিণত হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ঘুষ, প্রতারণা ইত্যাদি অসামাজিক কার্যাবলি বেড়ে মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে সার্বিক অনিশ্চয়তা ও হতাশা। এর ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বেকারত্বের পরিমাণ ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে।
৫. রাজনৈতিক প্রভাব
মুদ্রাস্ফীতির ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। জনজীবনে অসন্তোষের কারণে দেশে সুশাসন ব্যাহত হতে পারে।
শেষকথা
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির সুদূর প্রসারী প্রভাব রয়েছে। তাই দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রতিরোধে আরো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।