Home » বিশ্বায়নের সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর

বিশ্বায়নের সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর

by Rezaul Karim
বিশ্বায়নের সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর

প্রিয় পাঠক, বিশ্বায়ন একদিকে যেমন অনেক সুবিধার সৃষ্টি করেছে, আরেকদিকে তেমনি অনেক অসুবিধারও জন্ম দিয়েছে। আজকের ব্লগে বিশ্বায়নের এই সুবিধা ও অসুবিধা গুলো তুলে ধরা হলো। আশাকরি, এর মাধ্যমে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।

বিশ্বায়নের সুবিধা

বিশ্বায়নের ফলে যেসব সুবিধা গুলো সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ-

(i) উপকরণের গতিশীলতা: বিশ্বায়নের ফলে সমগ্র বিশ্বব্যাপী উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণের গতিশীলতা তথা শ্রম, পুঁজি ও প্রযুক্তির প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে দেশ, অঞ্চল ও বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, বেকারত্ব হ্রাস পাবে।

(ii) নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব ও বিনিময়: বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবীর সকল দেশসমূহের মেধাবীদের সুসমন্বয়ের মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব হয় এবং বিভিন্ন দেশ এর সুফল ভোগ করতে পারে।

(iii) উদারীকরণ: এ প্রক্রিয়ায় বাণিজ্য উদারীকরণ, বাজার উন্মুক্তকরণ এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলে নেয়ার ব্যাপারে সকল দেশ একমত হয়েছে। ফলে পৃথিবীর সকল প্রান্তের প্রত্যেক মানুষ এর থেকে একইরূপ সুফল লাভ করবে।

বিশ্বায়ন কি | বিশ্বায়ন কাকে বলে | বিশ্বায়ন বলতে কি বুঝ

(iv) অধিক উৎপাদন: বিশ্বায়নের ফলে সম্পদের সর্বোচ্চ দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত হয়, অপচয় রোধ পায়, সর্বোচ্চ উৎপাদন সম্ভব হয়।

(v) দাম হ্রাস পায়: অবাধ প্রবাহের কারণে প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিভিন্ন পণ্য-সেবার দাম হ্রাস পায়। ক্রেতারা কম দামে ভালো মানের পণ্য ভোগ করতে পারে।

(vi) একচেটিয়া ব্যবসায়ীর অনুপস্থিতি: বহুদেশ বহু উদ্যোক্তার সমন্বয়েই বিশ্বায়ন। তাই এখানে যেকোনো পণ্য- সেবার বিকল্প যোগান একেবারেই পর্যাপ্ত। এরূপ অবস্থায় কোনো পণ্যের শুধু একক যোগান খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

(vii) জীবনের মানোন্নয়ন: বিশ্বায়নের ফলে বিভিন্ন দেশের জনগণ উন্নত দ্রব্য-সেবা ভোগের মাধ্যমে উন্নত জীবনের অধিকারী হতে পারে। মানুষের গড় ভোগ, গড় আয়ু বৃদ্ধি পায় এবং জীবনের মানোন্নয়ন ঘটে।

(viii) নির্ভরযোগ্য উন্নয়ন: বিশ্বায়নের সুফল ভোগ এবং ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি, শিল্প, সেবা প্রভৃতি খাতে নির্ভরযোগ্য (Sustainable) উন্নয়ন ঘটে। শিল্পায়নের মাধ্যমে দ্রুত বেকারত্ব হ্রাস পায়। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হয়।

সংক্ষেপে, বিশ্বায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের সাথে অর্থনৈতিক সুবিধার লক্ষ্যে জোট গঠন, জ্ঞানের বিস্তার, সাংস্কৃতিক বিপ্লব, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের নিকটে চিকিৎসা সেবা সম্প্রসারণ, অপরাধ দমন, জনপ্রশাসন পরিচালনা, ক্রীড়াসহ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

বিশ্বায়ন যেমন বাস্তবতা সম্পদের অসম বণ্টনও তেমনি বাস্তবতা। বিশ্বের ৬০০ কোটি মানুষের ২৫০ কোটি এখনও দরিদ্র অথচ মাত্র ১০টি বহুজাতিক কর্পোরেশন বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছে, উত্তরের দেশগুলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিশ্বনিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেও সম্পদের মালিকানা ও পরিভোগে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে-এগুলোই হলো প্রেক্ষিত যার মধ্যে চলছে বিশ্বায়ন এবং WTO কেন্দ্রিক বিষয়াদি। ১৯৯৪ সালে স্বাক্ষরিত উরুগুয়ে রাউন্ড GATT চুক্তিবলে ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) জন্ম গ্রহণের পর পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের অপ্রতিরোধ্য জোয়ার বিশ্বজয়ী হয়ে উঠেছে।

বিশ্বায়নের অসুবিধা

বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশ্বায়নের যেসব অসুবিধা পরিলক্ষিত হয় সেগুলো হলো-

(i) শ্রমজীবী জনগণকে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের শিকার করবে। আবার উন্নত জীবনযাপনের মোহে দক্ষ ও মেধাবী জনগণ বিদেশে গমন (Brain drain) এর ফলে দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়বে।

(ii) ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য অপরিহার্য সম্পদ, পরিবেশ অপচয়মূলকভাবে নিঃশেষ করে দেবে।

(iii) শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি সরবরাহ, সেনিটেশন, পরিবেশ উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি দ্রব্য ও সেবা সামাজিকভাবে কাম্য পরিমাণে উৎপাদিত হবে না।

(iv) এরূপ অর্থনীতিতে “প্রতিযোগিতা” চিরদিনই অলীক স্বপ্ন থেকে যাবে। বাস্তবে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বাজারের প্রতিযোগিতা এক ধরনের ‘মাৎস্যন্যায়’ প্রতিষ্ঠাই করে থাকে যেখানে বৃহৎ পুঁজিপতিরা ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বিকাশকে পদে পদে বিঘ্নিত করতে থাকবে। এদেশের তৈরী পোশাক শিল্পও চীন, ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, হংকং, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের সাথে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে, আরও হবে। ভবিষ্যতে এ শিল্পও গভীর সংকটে পড়তে পারে।

(v) বাজার অর্থনীতি মাদকদ্রব্য, অশ্লীল ছায়াছবি, জুয়াখেলা, ঘোড়দৌড়, ক্যাসিনো-ক্লাব ইত্যাদির মতো ক্ষতিকর দ্রব্য ও সেবা প্রতিষ্ঠানের পেছনে সামাজিক সম্পদ অপচয় করছে এবং আরো করবে। এর ফলে দুর্নীতি, মাদকাসক্তি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রভৃতি অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীরা অবমূল্যায়নের স্বীকার হচ্ছে।

(vi) এরূপ অর্থনীতি সামাজিক ন্যায় বিচারকে সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ বিধায় গণদারিদ্র্য, বেকারত্ব, জনসংখ্যা সমস্যা, নিরক্ষরতা, বুভুক্ষা ও পুষ্টিহীনতা সমস্যার অবসান ঘটাতে অপারগ।

(vii) বিশ্বায়নের এ বাস্তবতায় কথিত উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় উন্নত দেশগুলোর শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থায় উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশগুলোর নিজস্ব পণ্যদ্রব্যের বাজার ব্যবস্থা ধ্বংস হবে। কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিল্প কাঠামো ও আওতা উন্নত দেশ অপেক্ষা খুবই দুর্বল। ফলে দেশীয় শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হবে, রপ্তানি হ্রাস পেয়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

(ix) অনুন্নত দেশের কৃষিপণ্য বিশ্ব বাজারে সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না। এর ফলে অনুন্নত কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মধ্যে পার্থক্য দেখাও

(x) অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি করার উদ্যোগের ফলে বন-জঙ্গল ধ্বংস হয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে।

(xi) বিশ্বায়নের ফলে খুব সহজেই দেশীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। ভিনদেশি অপসংস্কৃতির ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গঠন হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।

অর্থাৎ বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিকগুলো হলো- পরিবেশ বিপর্যয়, ভিন্ন সংস্কৃতির আগ্রাসন, যুদ্ধ ও হুমকি, অপরাধের বিস্তৃতি, সনাতনী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং জাতিগত স্বকীয়তার বিলুপ্তি এবং দেশীয় টেকসই উন্নয়ন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে।

এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশি জনগণ কীভাবে বিশ্বায়নকে মোকাবিলা করবে, এটিই প্রশ্ন হতে পারে। যেহেতু আমাদের মূলধন বা পুঁজির স্বল্পতা রয়েছে তাই আন্তর্জাতিক শ্রম সম্পদ বাজারে আমাদেরকে যোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য এখনই নিজেদেরকে উদ্যোগী হতে হবে। এজন্য মানব সম্পদ উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। উন্নয়নের পথে সফল দেশগুলোর ইতিহাস আরো সাক্ষ্য দিচ্ছে, মানব উন্নয়নে সত্যিকার সফল কোনো দেশ বেশি দিন উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে থাকে না।

অতএব, সার্বজনীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর, বৈষম্যহীন ও সকল নাগরিকের জন্য অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি ও প্রয়াস চালানোর কোনো বিকল্প নেই।

তথ্য ও টেলি যোগাযোগ প্রযুক্তির চলমান বিপ্লব থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য কোনো ফায়দা তুলতে পারেনি। অথচ বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র ‘তথ্যপ্রযুক্তি’কে ঘিরেই আবর্তিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখানেই বাংলাদেশের দারিদ্র্য মুক্তির সোনালি সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে।

শেষকথা

বিশ্বায়নের সুবিধা ও অসুবিধা গুলো তুলনা করে এটা বলা যায় যে, কিছু অসুবিধা সৃষ্টি সত্ত্বেও বিশ্বায়ন মানবজাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এটি সমগ্র মানবজাতিকে একটা প্লাটফর্মে তুলে ধরেছে। যেমন- গুগল (Google) বিশ্বায়নের অন্যতম এক উদাহরণ।

Related Posts