মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু
মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বা প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির আচরণ এবং মানসিক প্রক্রিয়া। নিচে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো-
১. আচরণ (Behaviour)
আচরণ শব্দটির অর্থ মনোবিজ্ঞানে খুবই ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। আচরণ বলতে প্রাণির সেই সকল কার্যাবলিকে বোঝায় যা গবেষক বা কোনো ব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করতে পারে, লিপিবদ্ধ করতে পারে এবং গবেষণাগারে পরিমাপ করতে পারে। ক্রাইডার এবং অন্যান্যরা বলেন- আচরণ হলো যে কোনো কার্যকলাপ যাকে পর্যবেক্ষণ করা যায়, লিপিবদ্ধ এবং পরিমাপ করা যায়। জীবন্ত প্রাণিরা বা জীব-জন্তুরা একটি নির্দিষ্ট পরিসরে যে গতি-প্রকৃতি করে তা সবাই আচরণের অন্তর্ভুক্ত। (‘Behaviour is nay activity that can be observed recorded and measured. This includes, first, what living beings or organisms do that is, their movements in space.”)
মনোবিজ্ঞানীগণ আচরণকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করে থাকেন। নিম্নে তা আলোচিত হলো। যেমন-
বাহ্যিক আচরণ ও অভ্যন্তরীণ আচরণ (Overt and covert behaviour)
মনোবিজ্ঞানীগণ শুধু বাহ্যিক আচরণ নিয়েই আলোচনা করেন না, বরং অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া সম্বন্ধেও আলোচনা করে থাকেন। বাহ্যিক আচরণ বলতে সেই সব আচরণকে বোঝায় যা বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। যেমন: কথা বলা, গান গাওয়া, খেলাকরা ইত্যাদি। এ বাহ্যিক আচরণের মধ্য দিয়ে মনোবিজ্ঞানের গবেষণা শুরু হয় এবং এর উপর নির্ভর করে মনোবিজ্ঞানীগণ ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া সম্বন্ধে ধারণা লাভ করেন। অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াসমূহ হলো শিক্ষণ, স্মৃতি, প্রেষণা, আবেগ, প্রত্যক্ষণ, অনুভূতি, চিন্তন ইত্যাদি। এসব প্রক্রিয়াসমূহকে প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। এজন্য মনোবিজ্ঞানীগণ পরীক্ষণপদ্ধতি ও নিরীক্ষণপদ্ধতি ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান লাভ করেন। তাছাড়া, বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেও অভ্যন্তরীণ আচরণকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। যেমন, হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া ও রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করার জন্য পলিগ্রাফ যন্ত্র ব্যবহার করা হয় এবং মস্তিষ্কের বিদ্যুৎকার্য পর্যবেক্ষণের জন্য ইলেকট্রো এনসেফেলোগ্রাফ (EEG) ব্যবহার করা হয়।
মনোবিজ্ঞান কাকে বলে? মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। |
আণবিক আচরণ ও সামগ্রিক আচরণ (Molecular and molar behaviour)
আচরণকে আবার আণবিক আচরণ ও সামগ্রিক আচরণ এদুভাগে বিভক্ত করা যায়। আণবিক আচরণ হলো খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন আচরণ। অর্থাৎ আণবিক আচরণকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিশ্লেষণ করা হয়। পেশি সঞ্চালন, চক্ষুর পলক ফেলা, ইত্যাদিকে আণবিক আচরণ বলা হয়। সামগ্রিক আচরণ বলতে অর্থপূর্ণ আচরণ বা পরিপূর্ণ আচরণকে বোঝায়। যেমন, একজন খেলোয়াড় যখন মাঠে খেলা করে, তখন খেলার মাঠে তার সমগ্র আচরণকে সামগ্রিক আচরণ বলা যাবে। অন্যদিকে, খেলোয়াড়ের মাংসপেশি সঞ্চালনকে আচরণের একটি সূক্ষ্মতম অংশ হিসেবে ধরা হয়। আচরণের এসব সূক্ষ্মতম অংশকে আণবিক আচরণ বলে।
ঐচ্ছিক আচরণ বা অনৈচ্ছিক আচরণ (Voluntary and involuntary behaviour)
যেসব আচরণ সৃষ্টির পেছনে ব্যক্তির ইচ্ছা কাজ করে থাকে তাকে ঐচ্ছিক আচরণ বলে। এসব আচরণ সৃষ্টির ব্যাপারে ব্যক্তি সচেতনভাবে কাজ করে থাকে; যেমন- কথা বলা, খাদ্য গ্রহণ, খেলাধুলা করা ইত্যাদি। এরূপ আচরণের দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে: প্রথমত যে উদ্দীপক দ্বারা আচরণ সংঘটিত হয়, সেই উদ্দীপকটি বাধ্যতামূলকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। দ্বিতীয়ত আচরণের উদ্দেশ্য আগে থেকেই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে বা মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, যেসব আচরণ সংঘটিত হওয়ার পেছনে ব্যক্তির কোনো প্রকারের ইচ্ছাশক্তি কাজ করে না তাকে অনৈচ্ছিক আচরণ বলা হয়। প্রতিবর্তী ক্রিয়া এবং সহজাত প্রবৃত্তি অনৈচ্ছিক আচরণের পর্যায়ভুক্ত। আগুনে হাত লাগা মাত্রই হাত সরিয়ে আসে, এরূপ ক্রিয়াকে অনৈচ্ছিক ক্রিয়া বলে।
২. মানসিক প্রক্রিয়া (Mental processes)
ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, মানসিক প্রক্রিয়াসমূহ হলো চিন্তন, স্মৃতি, প্রত্যক্ষণ, আবেগ, প্রেষণা, স্বপ্ন ইত্যাদি। এসব প্রক্রিয়াকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা, রেকর্ড করা এবং পরিমাণ করা খুবই অসুবিধাজনক। এ কারণে কোনো এক সময় কিছু সংখ্যক মনোবিজ্ঞানী মানসিক প্রক্রিয়াকে মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু থেকে বাদ দিয়েছিলেন। আর এ জন্য তখন থেকে মনোবিজ্ঞানীগণ মানসিক প্রক্রিয়ার উপর গবেষণা করার জন্য বহু পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। অতি সাম্প্রতিক কালের মনোবিজ্ঞানীগণ অনুভব করেন যে, বিশেষ পরিস্থিতিতে আচরণের মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে মানসিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনুধ্যান করা সম্ভব, অর্থাৎ আচরণের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিলে মানসিক প্রক্রিয়ার মধ্যেও পরিবর্তন সংঘটিত হবে। যেমন একজন ব্যক্তির মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গের পরিমাপ থেকে মনোবিজ্ঞানী ঐ ব্যক্তির সচেতনের মাত্রা সম্পর্কে জানতে পারেন। একইভাবে রক্তচাপ ও প্রস্বেদনের পরিমাণ থেকে মনোবিজ্ঞানী ব্যক্তির মানসিক চাপ (Stress) সম্পর্কে জানতে পারেন। সুতরাং মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুতে আচরণের ন্যায় মানসিক প্রক্রিয়াও স্থান লাভ করেছে।
মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু নিম্নলিখিতভাবেও বর্ণনা করা যায়।
১. গবেষণাপদ্ধতি: মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণির আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অনুধ্যান করার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞান বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে; যেমন অন্তদর্শন, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতি, চিকিৎসামূলক পদ্ধতি, জরিপ পদ্ধতি ইত্যাদি। আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনুধ্যানের জন্য যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় সেগুলোর বিস্তারিত বিষয়ও মনোবিজ্ঞানের আলোচনার অংশ।
২. স্নায়ুতন্ত্র: আমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জৈবিক ঘটনাসমূহের প্রভাব অপরিসীম। স্নায়ুতন্ত্রের আলোচনার মাধ্যমে আমরা জৈবিক ঘটনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারি।
৩. প্রেষণা: ব্যক্তি বা প্রাণি তার প্রেষণা পূরণের জন্য কর্মে উদ্যোগী হয় এবং নির্বাচিত আচরণ করে। প্রাণি ও মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের প্রেষণার উদ্ভব হয়ে থাকে। এসব প্রেষণা মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
৪. আবেগ: আবেগ মনোবিজ্ঞানের একটি অন্যতম বিষয়বস্তু। আবেগের ক্রমবিকাশ, আবেগকালীন ব্যক্তির দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।
৫. শিক্ষণ: শিক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তি বিভিন্ন কলাকৌশল আয়ত্ত করে নতুন পরিবেশে দ্রুত এবং সঠিক প্রতিক্রিয়া করতে সক্ষম হয়। আর এ জন্য শিক্ষণ সম্পর্কিত মতবাদ, শ্রেণিবিভাগ, শিক্ষণের নীতিসমূহ মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত।
৬. স্মৃতি-বিস্মৃতি: স্মৃতি ও বিস্মৃতি মনোবিজ্ঞানে বিশেষভাবে আলোচিত হয়ে থাকে। কীভাবে শিক্ষণীয় বিষয়ব বস্তুকে স্মৃতি ভাণ্ডারে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ধরে রাখা যায় এবং শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুকে কেন আমরা ভুলে যাই। স্মৃতি- বিস্মৃতি আলোচনার মাধ্যমে এসব প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়।
৭. প্রত্যক্ষণ: কীভাবে আমরা অসংগঠিত বিষয়কে সংগঠিত করে প্রত্যক্ষণ করি তা প্রত্যক্ষণ আলোচনা থেকে জানা যায়। আর এ জন্য প্রত্যক্ষণের সংগঠন, প্রতীক-পটভূমি সম্পর্ক, গভীরতা প্রত্যক্ষণ, অলীক প্রত্যক্ষণ, ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
৮. বুদ্ধি: বুদ্ধি সম্পর্কিত আলোচনা মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের বৃদ্ধি অভীক্ষা প্রণয়ন করে মানুষের বুদ্ধির পরিমাণ নির্ণয় করে থাকেন।
৯. হতাশা ও দ্বন্দ্ব: হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তির হতাশার কারণ উদ্ঘাটন করা এবং হতাশা ও দ্বন্দ্বের কুফল কী তা মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত।
১০. অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি: অন্তক্ষরা গ্রন্থি নিঃসৃত হরমোনের আধিক্য ও স্বল্পতা ব্যক্তির আচরণের ওপর কিরূপ প্রভাব বিস্তার করে তা মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে থাকে।
১১. ব্যক্তিত্ব: ব্যক্তিত্ব মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যক্তিত্বের স্বরূপ, উপাদান, প্রকারভেদ এবং ব্যক্তিত্বের পরিমাপপদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে এ বিজ্ঞান আলোচনা করে থাকে।
১২. সামাজিক আচরণ: সামাজিক পরিবেশে ব্যক্তি কী ধরনের আচরণ করে তা মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। শিশুর সামাজীকরণ, সামাজিক রীতি-নীতি, মূল্যবোধ, মনোভাব, জনমত, প্রচারণা প্রভৃতি সামাজিক দিকসমূহও আলোচিত হয়।
১৩. শিল্পক্ষেত্রে আচরণ: শিল্প কারখানার যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, উৎপন্ন দ্রব্য-সামগ্রীর বাজারজাতকরণ, কর্মচারী নির্বাচন, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে মানুষ যেসব আচরণ করে মনোবিজ্ঞান তা আলোচনা করে থাকে।
১৪. শিশুর আচরণ: শিশুর বয়স বৃদ্ধির ফলে তার দৈহিক ও মানসিক বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটিত আচরণসমূহ মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে থাকে।
১৫. শিক্ষাক্ষেত্রে আচরণ: শিক্ষাদানের বিভিন্ন পদ্ধতি, পরীক্ষাপদ্ধতি, শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, ছাত্রদের যুগোপযোগী পাঠসূচি প্রণয়ন প্রভৃতির আলোকে যেসব আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়া ঘটে তাও মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।
১৬. উপদেশ ও নির্দেশনা: মানসিক অস্থিরতা, বৃত্তি নির্বাচন, পারিবারিক সমস্যা, হতাশা ও দ্বন্দ্ব প্রভৃতি আচরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে উপদেশ ও নির্দেশনা দিয়ে স্বাভাবিক আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়া করতে মনোবিজ্ঞানীগণ ব্যক্তিকে সাহায্য করেন। তাই উপদেশ ও নির্দেশনা মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।
১৭. চিকিৎসার ক্ষেত্রে: চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে মানসিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার কাজ সহজতর হয়েছে। তাই মানসিক রোগ, মানসিক রোগের প্রকারভেদ ও চিকিৎসাপ্রণালি মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।