Home » মনোবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর

মনোবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর

by Rezaul Karim
মনোবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর, মনোবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা,

আধুনিক মনোবিজ্ঞান আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার একটি বিশ্লেষণধর্মী বিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞান জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি অতি সমৃদ্ধ বিষয়। এ-প্রসঙ্গে রবার্ট এ বেরন ‘(২০০৪) বলেন- ‘as Psychology has matured and become an ever richer source of knowledge about human behaviour Persons in other fields have recognized this resource and put it to good use.” অর্থাৎ মনোবিজ্ঞান মানুষের আচরণ বিষয়ক একটি পরিপক্ব ও জ্ঞানের সমৃদ্ধ উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অন্যান্য বিষয়ের ব্যক্তিগণও এ সম্পদকে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন এবং এ জ্ঞানকে ভালো কাজে ব্যবহার করছেন।

মনোবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা

আধুনিক বিশ্বে বর্তমানে মনোবিজ্ঞান একটি জনপ্রিয় বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আমাদের সমস্যা প্রচুর এবং আমাদের আচরণও এক বিচিত্র বিষয়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমস্যার সমাধানের জন্য বহু রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন। এসব সমস্যা ব্যক্তিগত, সামাজিক, চিকিৎসা, শিক্ষা, শিল্প, নির্দেশনা প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। এসব সমস্যা সমাধানে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান অপরিহার্য। নিম্নে মনোবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো-

১. ব্যক্তিগত জীবনে

ব্যক্তিগত জীবনে মনোবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। যেমন, অন্যের সাথে কেমনভাবে আচরণ করতে হবে, কীভাবে পারিবারিক সমস্যা সমাধান করা যায়, কীভাবে স্মৃতিশক্তি বাড়ানো যায়, প্রভৃতি সমস্যা সমাধানে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান খুবই কার্যকর।

মনোবিজ্ঞানের শাখা সমূহ আলোচনা কর

২. সামাজিক জীবনে

সামাজিক জীবনে মনোবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যৌথভাবে বসবাস করতে হলে অন্যান্যদের সাথে কীভাবে মিশতে হবে, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে দলীয় ঐক্য ও সংহতি সমুন্নত রাখা যায় ইত্যাদি ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান অত্যন্ত প্রয়োজন।

৩. চিকিৎসাক্ষেত্রে

মানসিক রোগীদের যথাযথ চিকিৎসার জন্য মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানের প্রয়োজন। ব্যক্তির অস্বভাবী আচরণের প্রকৃতি, কারণ ও উৎস, মানসিক ব্যাধির প্রতিকার ও চিকিৎসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানের প্রয়োজন।

৪. শিক্ষাক্ষেত্রে

শিক্ষাক্ষেত্রে এ বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অনেক। এ বিজ্ঞান পাঠ করে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, পরীক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষাদানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বন্ধে জানা যায়।

৫. শিল্পক্ষেত্রে

শিল্পক্ষেত্রেও মনোবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শিল্পের উন্নতি প্রধানত শিল্প মনোবিজ্ঞানের নিয়ম নীতিগুলোকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করার ওপর নির্ভরশীল; যেমন, শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত কর্মচারী নির্বাচন করা, কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতি, কর্ম-বিশ্লেষণ, মানবসম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান খুবই প্রয়োজন। তাছাড়া, ক্রেতা সাধারণের কাছে উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রী অধিক আকর্ষণীয় করার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের সঠিক পথ নির্দেশ দান করে।

৬. নির্দেশনার ক্ষেত্রে

উপদেশ ও নির্দেশনার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের ভূমিকা অনেক। মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে একজন নির্দেশনা মনোবিজ্ঞানী সাহায্য করতে পারেন; যেমন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, বৈবাহিক জীবনে অশান্তি, বেকার সমস্যা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমস্যা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে নির্দেশনা মনোবিজ্ঞানী সাহায্য করে থাকেন।

৭. সামরিক ক্ষেত্রে

সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা-পরিচালনার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের ভূমিকা কম নয়। মনোবিজ্ঞানীরা যেসব ব্যক্তিত্ব অভিক্ষা ও বুদ্ধি অভিক্ষা প্রণয়ন করেছেন তা সামরিক বাহিনীর লোক নির্বাচনের সময় প্রয়োগ করা হয়।

৮. অপরাধ দমনে

সমাজের শাস্তি, শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং খুন, সন্ত্রাস ইত্যাদি অপরাধমূলক কার্য সংশোধনের জন্য মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের প্রেষণা, আবেগ, মনোভাব সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে সচেতন। এজন্য অপরাধীর মোটিভ বা উদ্দেশ্য সম্বন্ধে, মনোবিজ্ঞানী সহজেই ধারণা করতে পারেন।

৯. শিশুদের ক্ষেত্রে

সন্তান মাতৃগর্ভে থাকার সময় এবং ভূমিষ্ঠ হবার পর মায়ের ও পরিবারের করণীয় কী, কীভাবে শিশুকে লালন-পালন করতে হবে। আদর্শ নাগরিক হিসেবে শিশুকে গড়ে তোলা যায় কীভাবে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আমরা শিশু মনোবিজ্ঞান পাঠ করে জানতে পারি।

১০. বিকাশ সম্পর্কিত জ্ঞানের ক্ষেত্রে

মাতৃগর্ভে ২৭০ থেকে ২৮০ দিন অবস্থানের পর গর্ভস্থ শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। সন্তানের গর্ভকালীন বিকাশ ও জন্মের পরবর্তী বিকাশ বিশেষ করে নবজাতককাল, বাল্যকাল, শৈশবকালের শারীরিক, মানসিক, ভাষাগত, আবেগগত ও সামাজিক বিকাশ সম্পর্কিত জ্ঞান আমরা বিকাশ মনোবিজ্ঞান পাঠে জানতে পারি।

মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু আলোচনা কর

১১. প্রকৌশলের ক্ষেত্রে

প্রকৌশল মনোবিজ্ঞান যেসব বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করে তা হলো শিল্পকর্ম পরিবেশের উন্নয়নের জন্য-প্রশস্ত কর্মস্থল, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা, যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য স্বচ্ছন্দভাবে বসার ব্যবস্থা এবং মানুষের কর্মক্ষমতার উপযোগী যন্ত্রপাতির নকশা প্রণয়ন ইত্যাদি। তাছাড়া এরূপ যন্ত্রপাতি এমন হবে যাতে এটি ব্যবহারে খরচ কম হয় এবং উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর পরিমাণ ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। আমরা প্রকৌশল মনোবিজ্ঞান পাঠ করে এসব বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে থাকি।

১২. ব্যবসাক্ষেত্রে

ব্যবসা-বাণিজ্যে সফলতা লাভের জন্য মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন করলেই ব্যবসায়িক কাজ সম্পন্ন হয়ে যায় না। উৎপন্ন পণ্যসামগ্রীর বাজারজাতকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উৎপাদিত পণ্যের প্রতি ভোক্তার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য প্রচারণা চালাতে হয়। তাছাড়া, উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর মধ্যে ভোক্তা কোন বিশেষ দ্রব্যটি পছন্দ বা অপছন্দ করছে তা জানার জন্য ভোক্তা জরিপ করতে হয়। এসব বিষয় আমরা শিল্প মনোবিজ্ঞান পাঠ করে জানতে পারি।

১৩. প্রশাসনের ক্ষেত্রে

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সুযোগ্য প্রশাসকের প্রয়োজন। একজন সফল প্রশাসককে তাঁর প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আবেগ, প্রেষণা, মেজাজ, দ্বন্দ্ব, হতাশা, শক্তি, সাহস, কর্মক্ষমতা, প্রত্যক্ষণ, মনোযোগ, বুদ্ধি ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে দৃষ্টি রাখতে হয়। একজন দক্ষ প্রশাসক মনোবিজ্ঞান পাঠ করে এসব বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন।

১৪. বিশেষ প্রবণতা পরিমাপের ক্ষেত্রে

শিল্পক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যপূর্ণ পেশা রয়েছে। এসব পেশার জন্য বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির প্রয়োজন। ব্যক্তির বিশেষ প্রবণতা (special aptitude) পরিমাপের জন্য মনোবিজ্ঞানী অনেক অভীক্ষা প্রণয়ন করেছেন। যেমন, পার্থক্যমূলকপ্রবণতা অভীক্ষা (Differential Aptitude Test), সাধারণ প্রবণতা অভীক্ষাগুচ্ছ (General Aptitude Test Battery), কারিগরি ক্ষমতা অভীক্ষা (Mechanical Ability Test) সংবেদী প্রবণতা অভীক্ষা (Sensory aptitude test) ইত্যাদি। মনোবিজ্ঞান পাঠে এসব বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।

১৫. বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে

মনোবিজ্ঞানীগণ মানুষের বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্ব পরিমাপের জন্য অনেক অভীক্ষা প্রণয়ন করেছন। বুদ্ধির অভীক্ষাসমূহ হলো: বিনে-সাইমন বুদ্ধি অভীক্ষা, স্ট্যানফোর্ড-বিনে বুদ্ধি স্কেল, ওয়েশলারের বৃদ্ধি অভীক্ষা, ‘দি আর্মি আলফা অভীক্ষা,’ দি আর্মি বিটা অভীক্ষা, আর্মি জেনারেল ক্লাসিফিকেশন অভীক্ষা, পাশ এলং অভীক্ষা, ব্লক ডিজাইন অভীক্ষা ইত্যাদি। আবার ব্যক্তিত্ব পরিমাপের জন্য মনোবিজ্ঞানীগণ প্রক্ষেপণমূলক ও অপ্রক্ষেপণমূলক অভীক্ষা প্রণয়ন করেছেন। আমরা মনোবিজ্ঞান পাঠে এসব অভীক্ষা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি।

সুতরাং মানবজীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে মনোবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মানুষের কল্যাণের জন্যই মনোবিজ্ঞান। মানুষ যেখানে বসবাস করে বা যেসব সংস্থায় কর্মে নিয়োজিত রয়েছে সেসব ক্ষেত্রেই মনোবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়েছে।

Related Posts