প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, তোমরা হয়তো জানো না লোকাচার কি, লোকাচার কাকে বলে? আর তাই এই লেখাটি পড়তে এসেছো। তোমাদের কথা ভেবেই এই লেখাটি সাজিয়েছি লোকাচার কি ও লোকাচার কাকে বলে সে সম্পর্কে। লেখাটি পড়ে তোমরা অনেক কিছুই জানতে পারবে। অনেকগুলো তথ্য দিয়ে এই লেখাটি লিখেছি।
লোকাচার কি বা লোকাচার কাকে বলে
অধ্যাপক উইলিয়াম গ্রাহাম সামনারই (William Graham Sumner) বহুল ব্যবহারের দ্বারা ‘লোকাচার’ (Folkways) শব্দটিকে জনপ্রিয় করেছেন। তিনিই ১৯০৬ সালে প্রকাশিত ‘লোকাচার’ (Folkways) শীর্ষক গ্রন্থে লোকাচার শব্দটি ব্যবহার চালু করেন। তাঁর প্রিয় ভাবশিষ্য সমাজবিজ্ঞানী কেলার তাঁর ভাবধারাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান।
অধ্যাপক সামনার তাঁর ‘Folkways’ শীর্ষক গ্রন্থে লোকাচারের ধারণা, উদ্ভব, প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্যকে অনুসরণ করে বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে। লোকাচার (Folkways) বলতে সামনার সমাজের এমন কতকগুলো সাধারণ রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানকে বুঝিয়েছেন যেগুলো মানুষের সামাজিক জীবনের সমস্যার সাথে গভীরভাবে জড়িত।
সুশৃঙ্খল ও স্বচ্ছন্দ সমাজজীবনের স্বার্থে সৃষ্ট শিষ্টাচার, আচার ব্যবহারের স্বীকৃত রীতি সংক্ষেপে বহুবিধ ব্যবহার বিধির সবকিছুই লোকাচারের অন্তর্ভুক্ত। জন্ম-মৃত্যু- বিবাহ, যৌনজীবন, পূজা পার্বণ, পোশাক পরিচ্ছদ, চাল-চলন, কথাবার্তা, আহার-বিহার প্রভৃতি সমাজস্থ মানুষের জীবনযাত্রার নানা রকম সাধারণ রীতির মাধ্যমে লোকাচারের প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ সমাজবদ্ধ মানুষের ব্যবহার বিধি বা আচার-আচরণের রীতি হলো লোকাচার। সমাজে স্বচ্ছন্দভাবে বসবাস করার উদ্দেশ্যে সমাজবাসীদের দ্বারা উদ্ভাবিত আচার-আচরণের বিচিত্র রীতি, শিষ্টাচার প্রভৃতি এ লোকাচারের অন্তর্ভুক্ত।
আরও পড়ুন: প্রথা কি বা কাকে বলে?
সামলারের মতে, মানুষ লোকাচারের মাধ্যমে নিজেকে পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে নেয়। আদিম মানুষ সামাজিক প্রথাকে অন্ধভাবে মেনে চলত। কারণ আদিম মানুষ পূর্ব পরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু দৈহিক, মানসিক প্রলক্ষণ এবং প্রবৃত্তি বা প্রেরণা পেয়েছে। এসব প্রলক্ষণ ও প্রবণতা খাদ্য, বাসস্থান, যৌন জীবন প্রভৃতি ক্ষেত্রসমূহে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে মানুষকে সাহায্য করে থাকে। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে গিয়ে মানুষের মধ্যে উপর্যুক্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য ও মতৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে। সামনারের মতানুসারে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পারস্পরিক মতামত বিনিময় ও মতৈক্যের ভিত্তিতে লোকাচারের সৃষ্টি হয়েছে। আবার কিছু কিছু নীতি যে আবহামানকাল যাবৎ প্রচলিত ঐতিহ্য ও প্রথা থেকে স্বতই গড়ে উঠে জনগণের দৈনন্দিন জীবনে একটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কার্যকর থাকে, যেগুলোর বাধ্যতামূলক চরিত্র খুব একটা নেই, সেই সাধারণ কথাটি বুঝাবার জন্যই তিনি লোকাচার শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, যেসব আচরণ বিধি লঙ্ঘন করলে সমাজের তরফ থেকে কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা বা জোরজবরদস্তি খাটানো হয় না, এ জাতীয় বিধিকে সামনার লোকাচার বলে আখ্যাত করেছেন।
লোকাচারের প্রকারভেদ
লোকাচার নানা প্রকারের হতে পারে। আমরা এখানে সংক্ষেপে তা আলোচনা করছি:
১. বেশভূষা সংক্রান্ত
নানা প্রকার লোকাচার সমাজে প্রচলিত আছে। যেমন- মহিলারা যে ধরনের বেশভূষা করে বিবাহ বাসরে যান, ঠিক সেভাবে সাজসজ্জা করে কোন শোকানুষ্ঠানে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বা শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যান না। এটিই সাধারণ রীতি বা লোকাচার।
২. আচরণ সম্পর্কিত
প্রত্যেক সমাজেই আচরণ সংক্রান্ত লোকাচার পরিলক্ষিত হয়। তবে এর প্রকৃতিগত আচরণেও বৈচিত্র্যতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন- কোন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়ে যখন একই সময়ে একই সারিতে বসে খাওয়া হয়, তখন সকলে একই সঙ্গে আরম্ভ করা ও সকলের সাথে একই সঙ্গে খাবার স্থান ত্যাগ করাটাকে আচরণ সংক্রান্ত লোকাচার বলা হয়।
৩. শিষ্টাচার সম্পর্কিত
প্রাসঙ্গিক বা সময়োপযোগী আচরণ বা কথাবার্তার মাধ্যমে শিষ্টাচার সম্পর্কিত লোকাচারের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। যেমন- প্রথম পরিচিতিতেই যদি তার মাসিক চাকরির বেতন, আয়ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় তাহলে তা লোকাচার বিরুদ্ধ আচরণ বলে গণ্য করা হয়। আবার নিমন্ত্রিত অতিথিদের সমাদর, আপ্যায়নের জন্য বিনয়ী স্বভাবসুলভভাবে তাদের আশানুরূপ আপ্যায়নের ব্যবস্থার ত্রুটির খোঁজখবর নেয়া গৃহকর্তার এরূপ আচরণ এবং নিমন্ত্রিতদেরও শিষ্টাচারসম্মত আচরণ হলো প্রশস্তিসূচক বাক্য প্রয়োগ করা।
উপরে উল্লিখিত লোকাচারগুলোকে যদি কেউ পালন না করে লোকাচার লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলবে না ঠিকই, কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে এরূপ আচরণকে স্বাভাবিক বিধিবহির্ভূত, নিন্দনীয়, শিক্ষাদীক্ষা বা মার্জিত রুচিসম্মত নয় বলে সামাজিকভাবে মৃদু অনুযোগের গুঞ্জন উঠবেই। অবশ্য আবার কানাঘুষা করেই ক্ষান্ত হয়ে যায়। সমাজে এমন অনেক লোকাচার রয়েছে যা মোটেই বুদ্ধিগ্রাহ্য নয়। যেমন- নব বিবাহিত বধূকে ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে রাখার রীতি প্রচলিত আছে।
এখন প্রশ্ন হলো লোকাচার সমাজে কিভাবে দেখা দেয়? সামনারের মতে, লোকাচার সমাজে অতি স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেয়। এমন কি মানুষের দ্বারা সুপরিকল্পিতভাবে যদি কোন লোকাচার সৃষ্টি হয় তাও পরিণামে সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, লোকাচার অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ব্যাপার। কাজেই লোকাচার স্রষ্টা হিসেবে কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রশংসা করার প্রয়োজন নেই।
লোকাচারের উদ্ভবের সঠিক কারণ অনুধাবন করা না গেলেও এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, লোকাচারের ভূমিকা সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোকাচার সমাজস্থ মানুষের আচার ব্যবহারকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এ হলো এক তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক শক্তি। সমাজজীবনে আইনের শাস্তির চেয়ে লোকনিন্দার গ্লানি কম দুঃসহ নয়। সমাজবাসীদের জীবনধারার সাথে লোকাচারসমূহ এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে যে, এগুলোকে বাদ দিয়ে সুস্থ, স্বাভাবিক ও সুন্দর সমাজজীবন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অধ্যাপক সামনারের মতানুসারে মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিটি পর্যায়ে এবং যুগ তার সমগ্র জীবন বহুবিধ লোকাচারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এবং হয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক কিংসলে ডেভিসের মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, “If the alpha and omega of human existence are to be found anywhere, it is in the folkways, for we begin with them and always come back to them.” অর্থাৎ, সমাজতাত্ত্বিক ধারণায় মানব অস্তিত্বের আদ্যন্ত পরিচয় যদি কোথাও পেতে হয়, তবে তা পাওয়া যাবে লোকাচারের মধ্যে। কেননা আমরা লোকাচার দিয়ে শুরু করি, আর ফিরেও আসি সেই লোকাচারে।
1 comment
[…] লোকাচার কি | লোকাচার কাকে বলে […]
Comments are closed.