সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি তত্ত্ব
সংস্কৃতি গতিশীল তথা পরিবর্তনশীল। এর দু’টি প্রকরণ বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতি সমান গতিতে পরিবর্তন হয় না। একটি অপরটি অপেক্ষা এগিয়ে চলার কারণে একটি ব্যবধানের সৃষ্টি হয় যা Cultural Lag বা সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি নামে পরিচিত।
সমাজবিজ্ঞানী Sumner, Miller-Lyer, Vice Kandt, Wallas ও Spencer প্রমুখের রচনায় সংস্কৃতির অসম অগ্রগতির ধারণা পাওয়া গেলেও William F. Ogburn-ই এ ধারণা বা চিন্তাকে সুস্পষ্ট তাত্ত্বিক মতবাদে উন্নীত করেন। তিনি ১৯২২ সালে তাঁর ‘Social Change’ গ্রন্থে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি সম্পর্কে সর্বপ্রথম সংজ্ঞা প্রদান করেন। তাঁর প্রদত্ত সংজ্ঞাটি হলো, “The situation in which one complex moves ahead, leaving a dependent and related complex unchanged or hanging but slowly is called a cultural lag.”
আরও পড়ুন: বস্তুগত সংস্কৃতি কি? অবস্তুগত সংস্কৃতি কি?
Ogburn পরবর্তীকালে Nimkoff এর সাথে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ‘A Hand Book of Sociology’ গ্রন্থে অভিমত ব্যক্ত করেন, “The strain that co- exists between two correlated parts of culture that change at unequal tates of speed.” অর্থাৎ, কোন সংস্কৃতির মধ্যে অসম গতিতে চলমান দু’টি অংশের মধ্যে বিদ্যমান Strain বা চাপ হলো সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি।
মৌল বিষয়
তাঁর তত্ত্বের মৌল বিষয় বস্তুগত সংস্কৃতি; যেমন- পোশাক- পরিচ্ছদ, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, উৎপাদন যন্ত্র ইত্যাদি যে গতিতে বা দ্রুত হারে সামনের দিকে এগিয়ে যায় বা পরিবর্তন হয় সে তুলনায় অবস্তুগত সংস্কৃতি; যেমন- ভাষা, ধর্ম, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, পরিবার, শিক্ষা ইত্যাদি এগুতে পারে না। ফলশ্রুতিতে এ দুই সংস্কৃতির মধ্যে একটি অসঙ্গতি বা পার্থক্য দেখা দেয়। এটিই সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি তত্ত্ব।
আমরা কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে অগবার্নের উপরিউক্ত বক্তব্যটি ব্যাখ্যা করছি।
যখন যাতায়াত করার যান হিসেবে ঢাকা নগরীতে ঘোড়ার গাড়ির ব্যাপক প্রচলন ছিল বা মালবাহী গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল তখন ঢাকা নগরীর রাস্তাঘাটগুলো সে অনুযায়ী তৈরি হলো। কিন্তু যখন ঘোড়ার গাড়ি ও গরুর গাড়ির প্রচলনের পরিবর্তে ট্রাক ও মোটরগাড়ির প্রচলন আরম্ভ হলো তখন প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তাঘাট অত্যন্ত সংকীর্ণ মনে হলো। আবার মোটরগাড়ির প্রচলনের পূর্বে রাস্তাঘাটে যান চলাচলের জন্য যেরূপ আইনকানুন ছিল, তা মোটরগাড়ি ও ট্রাক প্রচলনের পর অনুপযোগী হয়ে পড়ে। মোটরগাড়ি প্রচলনের সাথে সাথে যানবাহনের ও রাস্তাঘাটে চলাচলের জন্য যদি নতুন নিয়মকানুন প্রবর্তন করে তাহলেও জনগণের পক্ষে মেনে চলতে সময় লাগবে। কারণ দীর্ঘদিনের অভ্যাসজনিত নিয়ম হঠাৎ করে বর্জন করা ও নতুন নিয়ম মেনে চলার ক্ষেত্রেও অসুবিধা হয়ে পড়ে। এখানে সংস্কৃতির বস্তুগত দিক হলো মোটরগাড়ি, ট্রাক আর অবস্তুগত দিক হলো নিয়মকানুন। এখানে বাস্তব উপাদান মোটরগাড়ির প্রচলন ও অবাস্তব উপাদান নিয়মকানুন প্রবর্তন এ দু’য়ের মধ্যে সঙ্গতিপূর্ণ পরিবর্তন হতে বিলম্ব ঘটে।
তাছাড়া ইংরেজ মনীষী বেকন বলেছেন যে, “Knowledge comes but wisdom lingers.” এ উক্তি থেকে আমরা জানি যে, মানুষের বিদ্যা (Knowledge) যে পরিমাণ বৃদ্ধি হচ্ছে তদনুযায়ী তার বিজ্ঞতা (Wisdom) বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তখন এরূপ অসঙ্গতির ইঙ্গিত বুঝায়।
আরও পড়ুন: সংস্কৃতির উপাদান গুলো কি কি?
সমাজে এরূপ অসঙ্গতি বৃদ্ধি পাওয়ার আরো অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের দেশের পরিস্থিতি থেকেও উদাহরণ দেওয়া যায়; যেমন- স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর আমাদের দেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু এরূপ শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে গেলে অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিক ধাঁচ ও রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকা প্রয়োজন; কিন্তু স্বাধীনতার পর আমাদের দেশের সমাজে অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটে নি। ফলে সমাজে দুষ্ক্রিয়তা থেকে মুক্ত হবার অনুকূল পরিবেশ না থাকাতে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে নি।
উপরিউক্ত উদাহরণগুলো থেকে আমাদের সামাজিক অসঙ্গতির কারণগুলো ব্যক্ত করা হলো। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, এরূপ সামাজিক অসঙ্গতি থেকে সামাজিক সমস্যার উদ্ভব ঘটে; যেমন- ঢাকা শহরে ইসলামপুর রোড ও নওয়াবপুর রোড সংকীর্ণ হবার ফলে যানবাহন ভিড়ের দরুন নগরজীবন যে কত সমস্যাসঙ্কুল হয়ে পড়েছে তা সর্বজনবিদিত।
Ogburn এর তত্ত্বটিকে নিম্নোক্ত চিত্রের সাহায্যে দেখানো হলো-
এখানে,
OB = Material Culture (বস্তুগত সংস্কৃতি)
OA = Non-Meterial Culture (অবস্তুগত সংস্কৃতি)
AB = Culture Lag (সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি)
OX = Time (সময়)
OY = Speed of Culture (সংস্কৃতির গতি)
Ogburn এর ধারণানুযায়ী সংস্কৃতির দু’টি দিকের একটি হলো স্বাধীন এবং অপরটি হলো অধীন বা নির্ভরশীল। সংস্কৃতির স্বাধীন দিকটি নির্ভরশীল দিককে পিছনে ফেলে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। এর ফলে দ্রুত পরিবর্তনশীল বা স্বাধীন দিক এবং মন্থর পরিবর্তনশীল বা অধীন দিকের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয় যা পুরো সংস্কৃতিতে একটি ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি করে।
Ogburn এর মতে, নিম্নলিখিত প্রক্রিয়ায় বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে পরিবর্তন সাধিত হয়। যথা:
বস্তুগত সংস্কৃতি (Material Culture) | To | বস্তুগত সংস্কৃতি (Material Culture) |
অবস্তুগত সংস্কৃতি (Non-(Material Culture) | To | অবস্তুগত সংস্কৃতি (Non-(Material Culture) |
বস্তুগত সংস্কৃতি (Material Culture) | To | বস্তুগত সংস্কৃতি (Material Culture) |
অবস্তুগত সংস্কৃতি (Non-(Material Culture) | To | অবস্তুগত সংস্কৃতি (Non-(Material Culture) |
Ogburn এর মতে, সংস্কৃতির অসম অগ্রগতির কারণগুলো হলো:
i. প্রয়োগমূলক সংস্কৃতিতে আবিষ্কারের অপ্রতুলতা। (Scarcity of invention in the adaptive culture.)
ii. প্রয়োগমূলক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কারিগরি বাধা। (Mechanical obstacles to changes in adaptive.)
iii. সমাজের বৈসাদৃশ্যতা। (Heterogeneity of society.)
iv. বস্তুগত সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের অভাব। (Lack of closeness of contact with material culture.)
V. অবস্তুগত সংস্কৃতির সাথে প্রয়োগমূলক সংস্কৃতির সংযোগ। (The connection of the adaptive culture with the other part of the non-material culture.)
vi. গোষ্ঠী মূল্যায়ন। (Group valuation.).
সমালোচনা
সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন সাংস্কৃতিক অসম অগ্রগতি তত্ত্বের যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তা নানা দিক থেকে সমালোচনা করা হয়েছে। যথা: প্রথমত, সমালোচকগণ মনে করেন যে, অগবার্ন জীবনধারার বাস্তব উপাদানসমূহের সাথে প্রতীকমূলক উপাদানসমূহের যে পশ্চাদবর্তিতা লক্ষ্য করেছেন তা অনেক ক্ষেত্রেই মেনে নেওয়া যায় না। কারণ যেসব বাস্তব উপাদানের সৃষ্টি হয়েছে তা মানুষের চিন্তাভাবনারই ফলশ্রুতি। এসব উপাদানের সাথে মানুষের অনুকূল মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দায়ী।
অতএব, এক্ষেত্রে বাস্তব উপাদানকে অগ্রগামী বলে মনে করলে মানুষের চিন্তাভাবনাকে পশ্চাদগামী বলে মনে করতে হয়। কিন্তু বাস্তব উপাদানসমূহের সাথে মানুষের অনুকূল পরিবেশ থাকলে প্রতীকমূলক উপাদানগুলোর কোন অসমতার সৃষ্টি হয় না। সেক্ষেত্রে প্রতীকমূলক উপাদানকে পশ্চাতে ঠেলে দিয়ে বাস্তব উপাদানকে অগ্রগতি মনে করা যুক্তিসঙ্গত নয়। দ্বিতীয়ত, আমরা বলতে পারি যে, কেবল বস্তুগত দিকের মান নির্ণয় করে যে অগ্রগতি ও পশ্চাদগামী মনে করা হয়েছে তা যুক্তিসঙ্গত বলে মেনে নেওয়া যায় না। কারণ বস্তুগত উন্নতির সাথে সাথে মানুষের দক্ষতা, কলাকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যার যে উন্নতি হয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না।
তৃতীয়ত, বলা চলে যে, সমাজে নানাদিক থেকে পরিবর্তনজনিত কারণে যে অসমতার সৃষ্টি হয় তা কি কারণে এবং তার প্রকৃতি কি, সে সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কিন্তু অগবার্নের বিশ্লেষণে তা পরিস্ফুট নয়।
চতুর্থত, S. C. Gilfillan মনে করেন, সামাজিক পরিবর্তন প্রকৃতপক্ষে বহুবিধ জটিল উপাদানের ফলশ্রুতি বিধায় কোন একটি উপাদানকে প্রধানরূপে চিহ্নিত করা সঠিক নয়।
পঞ্চমত, এ তত্ত্ব অত্যন্ত জটিল, ভারসাম্য অত্যন্ত অনিশ্চিত।
পরিশেষে বলা যায়, Ogburn এর সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি তত্ত্বটি বিভিন্নভাবে সমালোচিত হলেও একথা সত্য যে, সামাজিক পরিবর্তনে বস্তুগত উপাদানের প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। মার্কসীয় ধারণার সাথে তাঁর তত্ত্বের কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে এবং সে কারণে পাশ্চাত্যের শিল্পোন্নত এবং তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাঁর তত্ত্বের কার্যকারিতা এবং গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।