সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য – সংস্কৃতি এবং সভ্যতা পারস্পরিক সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ। তথাপি এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য গুলো তুলে ধরা হল-
১. পরিমাপ: সংস্কৃতিকে সহজে পরিমাপ করা যায় না। এটি পরিমাপ করতে প্রয়োজন হয় বিমূর্ত কৌশলের। যেমন- আগ্রার তাজমহল সংস্কৃতির দিক দিয়ে নিউইয়র্কের জাতিসংঘ ভবনের থেকে বেশি মূল্যবান। অন্যদিকে, সভ্যতাকে সহজে পরিমাপ করা যায়। গরুর গাড়ির তুলনায় মোটরগাড়ি বেশি দ্রুত এবং যন্ত্রচালিত তাঁত হস্তচালিত তাঁতের তুলনায় বেশি শক্তিশালী এবং বেশি উৎপাদন করতে সক্ষম।
২. গতি: সংস্কৃতির চলমান গতি সভ্যতার চেয়ে কম এবং এটি ক্রমপুঞ্জীভূত নয়। অন্যদিকে, সভ্যতার গতি হচ্ছে দ্রুত এবং ক্রমপুঞ্জীভূত। যান্ত্রিক আবিষ্কারের ফলে এটি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। MacIver and Page এর কণ্ঠে তাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে, “Civilization is always advancing, but not culture.”
আরও পড়ুন: সভ্যতা কি বা সভ্যতা কাকে বলে?
৩. অংশীদারিত্ব: দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সকলেই সমানভাবে সংস্কৃতির অংশীদার হতে পারে না। অপরদিকে, সভ্যতার কীর্তিসমূহ সহজেই কোন একটি দেশ- কাল ও জাতি থেকে অন্য একটি দেশ-কাল ও জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
৪. অবদান: সংস্কৃতির অবদান সাধারণ মানুষ খুব সহজে বুঝতে পারে না, কিন্তু সভ্যতার অবদানগুলো সহজে বুঝা যায় এবং উপলব্ধি করা যায়।
৫. প্রকাশভঙ্গি: সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে প্রতীকের মাধ্যমে। অর্থাৎ সংস্কৃতি আত্মপ্রকাশ করে সাহিত্য, ললিতকলা, ধর্ম ও নৈতিকতার মাধ্যমে। অন্যদিকে অট্টালিকা, বাসস্থান, যন্ত্রশিল্প ইত্যাদির মাধ্যমে সভ্যতার প্রকাশ ঘটে।
৬. নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও প্রতিযোগিতা: সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। এখানে প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত। যদিও স্যাটেলাইটের বদৌলতে বর্তমানে সংস্কৃতিগত প্রতিযোগিতা কিছুটা পরিলক্ষিত হয়। অপরদিকে, সভ্যতার মৌল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়া। আর সে কারণেই এখানে তীব্র প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়।
৭. অর্জনের ধরনের ক্ষেত্রে: সংস্কৃতি হলো Achieved, অর্থাৎ সংস্কৃতি অর্জন করতে হয়। অপরদিকে, সভ্যতা হলো Ascribed, অর্থাৎ সভ্যতা হলো আরোপিত এবং এটি বংশপরম্পরায় অর্জন করা যেতে পারে।
৮. কল্যাণকর এবং অকল্যাণকর সংস্কৃতি: মানুষের মানসিক দিককে পরিতৃপ্ত করে। এটি কল্যাণকর এবং এর কোন ক্ষতিকর দিক নেই। কিন্তু সভ্যতার সূত্রে মানুষ বিভিন্ন ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও শক্তি লাভ করে। ফলে এটি কল্যাণকর এবং অকল্যাণকর উভয় কাজে ব্যবহৃত হয়।
৯. পরিণতি: সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরিণতি বা ফলাফল বড় কথা নয় বরং তার কর্মটি হলো মুখ্য। অন্যদিকে, সভ্যতার ক্ষেত্রে পরিণতি বা ফলাফলই মুখ্য বিবেচ্য বিষয়।
১০. অন্তঃস্থ ও বাহ্যিক: সংস্কৃতি হলো অন্তঃস্থ। অর্থাৎ, এটি হলো মানুষের আচরণের ভিতরের দিক। আমাদের চিন্তাভাবনা ও জীবনধারা, আচরণ, অনুভূতি, ধর্ম, শিল্পকলা ইত্যাদির মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে। অপরদিকে, সভ্যতা হলো চরিত্রগত দিক থেকে বাহ্যিক, যান্ত্রিক এবং উপযোগী।
১১. স্থায়িত্ব/ধ্বংস: সংস্কৃতি ক্রমপ্রসারমান এবং এর একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। সংস্কৃতিকে সহজে পরাজিত করা যায় না এবং এটি সহজে ধ্বংস হয় না। অপরদিকে, কোন অশুভ শক্তির আক্রমণে সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে। যেমন- মার্কিন বাহিনী কর্তৃক ইরাক আক্রমণের ফলে সে দেশের সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে কিন্তু সংস্কৃতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় নি।
১২. মানদণ্ড: মননশীলতার মানদণ্ডে সংস্কৃতিকে বিচার করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে, দক্ষতার মানদণ্ড অনুযায়ী সভ্যতার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
১৩. নিজস্বতা: সংস্কৃতির নিজস্ব সত্তা কিংবা জাতীয় রূপ থাকতে পারে। কিন্তু সভ্যতার ক্ষেত্রে তা পরিলক্ষিত হয় না।
১৪. বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতি: সংস্কৃতি হচ্ছে প্রধানত মানুষের অবস্তুগত সৃষ্টি। যদিও সংস্কৃতির বস্তুগত উপাদানও ক্রিয়াশীল। অন্যদিকে, সভ্যতা হচ্ছে মানুষের বস্তুগত সৃষ্টি।
১৫. মানবজীবন পরিচালনা: সংস্কৃতি মানুষকে আনন্দ দেয় এবং পরিতৃপ্ত করে। অন্যদিকে, সভ্যতা মানুষের জীবনযাত্রাকে স্বাচ্ছন্দ্য করে।
১৬. সমাজ পরিচালনা: সংস্কৃতিকে সমাজ পরিচালনার Steering wheel বা দিকনির্দেশক যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে, সভ্যতাকে Driving force of society বা সমাজ পরিচালনার শক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি তত্ত্বটি পর্যালোচনা কর
১৭. MacIver এর ধারাভাষ্যে সংস্কৃতি হলো আমরা যা তাই। অন্যদিকে, সভ্যতা হলো আমরা যা ব্যবহার করি বা আমাদের যা আছে।
১৮. Mathew Arnold এর ধারাভাষ্যে সংস্কৃতি হচ্ছে খাঁটি হওয়া বা মার্জিত হওয়া বা রুচিশীল হওয়া, অর্থাৎ Becoming something, অন্যদিকে, সভ্যতা হচ্ছে কোনকিছু থাকা, কোন পদার্থ বা বস্তু থাকা বা অর্জন করা, অর্থাৎ Having Something.
১৯. Alfred এর ধারাভাষ্যে সংস্কৃতি হলো শিল্পকলা, ধর্ম ও দর্শন। অন্যদিকে, সভ্যতা হলো জ্ঞানবিজ্ঞান ও কারিগরি পদ্ধতি দ্বারা প্রকৃতিকে বশে আনা।
২০. রবি ঠাকুরের ধারাভাষ্যে সভ্যতা হলো হীরক তুল্য এবং তা থেকে বিচ্ছুরিত আলোই হচ্ছে সংস্কৃতি।
সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে উপরিউক্ত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এরা একে অপরের পরিপূরক এবং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও অবিচ্ছেদ্য। কেননা অগ্রসরমান জটিল সংস্কৃতিই হলো সভ্যতা। বস্তুত একটি প্রবাহমান নদীর স্রোতধারা যদি হয় সংস্কৃতি তবে তাকে ঘিরে যে পলিমাটি বা তীর গড়ে উঠে তাই সভ্যতা।