সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা
কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস সমাজতন্ত্রের প্রধান প্রবক্তা। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ঠিক বিপরীত। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ (লেনিন)-এর নেতৃত্বে রাশিয়ায় সর্বপ্রথম সমাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন হয়। এরপর ১৯২৩ সালে New Economic Policy-এর মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। তারপর ১৯৩০ সালে জোসেফ স্ট্যালিন রাশিয়ায় মার্কসীয় অর্থনীতির মাধ্যমে Command বা Socialistic Economy চালু করেন। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় বেসরকারি মালিকানা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত এবং সরকারি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ কার্যকর থাকে। এখানে সকল সম্পদ পরিকল্পিতভাবে ব্যবহৃত হয়। এজন্য এ ব্যবস্থাকে ‘কেন্দ্রীয় পরিকল্পিত অর্থনীতি’ বলে।
এম. এন. লুক্স (M. N. Loucks) সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বলেছেন, “সমাজতন্ত্র একটি অর্থনৈতিক আন্দোলন যা বৃহৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রকৃতি প্রদত্ত ও মানুষের তৈরি উৎপাদক দ্রব্যসমূহের মালিকানাকে ব্যক্তির অধীন হতে সমাজের অধীনে আনয়ন করতে প্রয়াসী হয়, যেখানে ব্যক্তির স্বাধীন অর্থনৈতিক সত্তাকে সীমিত না করে, যা ব্যক্তির পেশাগত ও ভোগের স্বাধীনতাকে খর্ব না করে সমাজের ভিত্তিতে সম্পদ বণ্টন সম্ভব হয়।”
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা কাকে বলে | ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সমূহ |
অধ্যাপক জে. এফ. র্যাগান (J. F. Ragan) ও এল. বি. থমাস (L. B. Thomas) বলেন, “সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা হলো এরূপ একটি অর্থব্যবস্থা যেখানে সম্পত্তির রাষ্ট্রীয় মালিকানা বিদ্যমান এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।” (Socialistic economy is an economic system, in which property is publicity owned and central authorities co-ordinate economic decision.)
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে সমাজতান্ত্রিক মাত্রা বিভিন্ন হয়। কিন্তু সকল সমাজতান্ত্রিক দেশের অর্থনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ-
১. সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানা
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য দেশের সকল সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকে। দেশের সকল ভূমি, কলকারখানা ও উৎপাদনের উপকরণসমূহ ব্যক্তিমালিকানায় থাকে না। রাষ্ট্রই সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিক।
২. শিল্পের সামাজিকীকরণ
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সামাজিক কল্যাণের দিকে লক্ষ রেখেই শিল্পকলকারখানা পরিচালিত হয়। অনেক শিল্পের মূলধন খুব অধিক হওয়ায় ওই শিল্পে উৎপাদিত দ্রব্যের দাম, উৎপাদনের পরিমাণ, সম্পদের ব্যবহার, প্রযুক্তি ও শ্রমিক নিয়োগ হয়ে থাকে। ফলে এসব শিল্প সামাজিকীকরণ করা হয়। যেমন- রেলপথ, বিমানপথ, বিদ্যুৎ ইত্যাদি।
৩. সামাজিক নিরাপত্তা
সমাজতান্ত্রিক দেশে বেকার ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি সামাজিক নিরাপত্তা বিধানকারী সুবিধাসমূহ দেওয়া হয়। এছাড়া নীতিগতভাবে সকল সমাজতন্ত্রী বিশ্বাস করে যে, প্রত্যেক মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন সরকারকে মেটাতে হয়।
৪. শোষণহীন সমাজ
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সকল সম্পদের মালিক রাষ্ট্র। কাজেই উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিক কাজের ন্যায্য পারিশ্রমিক লাভ করে। ফলে পুঁজিপতি শ্রমিককে শোষণ করতে পারে না।
৫. আয়ের পূর্ণ বণ্টন
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকল্পে অধিক সমতামূলক আয়ের পুনর্বিন্যাসে কর্মসূচি গ্রহণ করে। প্রগতিশীল কর ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের ওপর অধিক হারে কর বসানো হয়। আবার নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের ওপর হতে কর হ্রাস করে দরিদ্রদের নিকট হতে কম হারে কর আদায় করা হয়।
৬. ব্যক্তিগত মুনাফার অনুপস্থিত
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মুনাফার সুযোগ নেই। সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানার সুযোগ নেই বলে ব্যক্তিগত মুনাফাও এখানে অনুপস্থিত।
৭. বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির অনুপস্থিতি
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় পরিকল্পনামাফিক উৎপাদন কাজ পরিচালিত হয়। এ ব্যবস্থায় উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় বেকার সমস্যা থাকে না এবং মুদ্রাস্ফীতি খুবই কম।
মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা গুলো কি কি? – ব্যাখ্যা কর |
৮. শ্রমিকের স্বার্থরক্ষা
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সরকার শ্রমিকের স্বার্থসংরক্ষণ করে থাকে। শ্রমিকের স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন, নিয়ন্ত্রিত মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি সরকার সতর্ক দৃষ্টি রাখে।
৯. কর্মসংস্থান
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সরকার কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করে। এ ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা অনুসারে চলে। নাগরিকের সব ধরনের নিরাপত্তা সরকার বহন করে। ফলে কোনো নাগরিকের কর্মসংস্থানের অভাব হয় না।
১০. কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা
সমাজতন্ত্রে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ উৎপাদনের যাবতীয় সিদ্ধান্ত সমাজের সর্বোচ্চ কল্যাণের ভিত্তিতে গ্রহণ করে। অর্থনীতির যাবতীয় কাজ একটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রচিত নির্দিষ্ট কর্মসূচি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। সমাজতন্ত্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার পূর্বপরিকল্পনার লক্ষ্য অনুযায়ী অর্থনীতিকে পরিচালিত করে। কাজেই সমাজতন্ত্রের প্রাণ হলো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা।
সমাজতন্ত্রের কোনো একক সংজ্ঞা দেওয়া দুরূহ। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রকৃতির ব্যবস্থাকে। সমাজতন্ত্র বলা হচ্ছে। সকল সমাজতন্ত্রের ধরন এক রকম হয় না। রাশিয়া, চীন, কিউবা এবং পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। তবে সমাজতন্ত্রের মূলকথা হলো, “প্রত্যেক শ্রমিক নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে।”