সমাজবিজ্ঞানের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক
প্রাচীনকালে ‘সমাজ ও রাষ্ট্র এ দু’টি প্রত্যয়কে গ্রিক দার্শনিক ও সমাজচিন্তাবিদগণ প্রায় একই অর্থে ব্যবহার করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রদর্শন থেকে সমাজ প্রত্যয়কে মৌল ও ব্যাপক অর্থে বুঝাতে গিয়ে সমাজতাত্ত্বিক ধারণার বিকাশ ঘটে। সমাজবিজ্ঞানী মরিস জিন্সবার্গের ধারণায় রাজনৈতিক অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে যখন সেই অনুসন্ধান রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে আরো প্রশস্ততর ক্ষেত্রে গিয়ে উপনীত হলো তখনই সমাজবিজ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে।
অধ্যাপক ডানিং এর মতে, “জাতির জীবনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা শুরু হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের অনেক পরে। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সমাজবিজ্ঞানের অনেক পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়েছে। মানুষ প্রথমে সমাজবদ্ধ হয়েছে। সমাজ গঠনের অনেক পরে মানুষের জীবনে রাজনৈতিক চিন্তাধারার সূত্রপাত ঘটেছে। অর্থাৎ সমাজজীবনের সূত্রপাত থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়েছে। অবশ্য এখানে বলা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক পদমর্যাদা সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠার বহু বছর পূর্ব থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
অন্যান্য লেখা:
সমাজবিজ্ঞানের সাথে নৃবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর।
সমাজবিজ্ঞানের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক আলোচনা কর
ইতিহাসের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা
সমাজবিজ্ঞান যেমন সমাজের উৎপত্তি, সমাজকাঠামো, প্রতিষ্ঠান, দল, পরিবার, সামাজিক স্তরবিন্যাস, শ্ৰেণী সমস্যা, সামাজিক সমস্যা, নৱারণ সম্পর্কে আলোচনা করে তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, সরকারের রূপ, শাসনতান্ত্রিক আইন, প্রশাসন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজানীতি, শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার্থে রাজনৈতিক দল কি প্রকার কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে তা পর্যালোচনা করে।
স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান আত্মপ্রকাশের পরও উভয় শাস্ত্র পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ। কারণ সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পর্যালোচিত বিষয় কোন কোন ক্ষেত্রে অবিচ্ছিন্ন মনে হয়। এ প্রসঙ্গে ফরাসি দার্শনিক পল জানে এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “সমাজবিজ্ঞানের যে অংশ রাষ্ট্রের মূলভিত্তি ও সরকারের নীতিসমূহ আলোচনা করে তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে।” (Political science is that part of social science which treats of the foundations of the state and principles of governments.)
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি যে, রাষ্ট্রের উৎপত্তি, সরকারের প্রকৃতি, রাজনৈতিক দল প্রভৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য সমাজবিজ্ঞানের বিস্তৃত পটভূমিতে রাষ্ট্রের পর্যালোচনা প্রয়োজন।
সমাজবিজ্ঞান একটি মৌলিক সামাজিক বিজ্ঞান; মানুষের সমাজজীবনের সামগ্রিক আলোচনারই বিষয়বস্তু। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমগ্র মানবজীবনের বিভিন্ন দিকের মধ্যে কেবল রাজনৈতিক দিকটির আলোচনাই এর বিষয়বস্তু। সেজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম বিশেষীকৃত শাখা হিসেবে গণ্য করা হয়। আবার সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও উভয়ের আলোচনা ক্ষেত্র আলাদা ।
আমরা এখানে সমাজবিজ্ঞানের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক ও পার্থক্যের কয়েকটি বিশেষ দিক উল্লেখ করছি।
১. সমাজবিজ্ঞান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নানা উপাদান ও উপকরণ সংগ্রহ করে : রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজস্থ মানুষের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ উদ্ভূত ঘটনা ও সমস্যা, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঐ ঘটনা বা সমস্যাকে প্রভাবিত করছে তার সবকিছুই বিশ্লেষণ করতে চায়। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জনের জন্য অবশ্যই সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত কলাকৌশল ও বিষয় সম্পর্কে অবহিত হতে হয়।
২. রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের উপাদানের যোগান দেয় : সমাজবিজ্ঞানীদের সমাজ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান আহরণে, সমাজের সমস্যার কারণ অনুসন্ধানে এবং নিজেদের গবেষণার জ্ঞান ভাণ্ডারকে পরিপুষ্ট ও সম্প্রসারণের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচ্যবিষয় থেকেও সাহায্য গ্রহণ করতে হয়।
৩. রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও সামাজিক মূল্যবোধের বিশ্লেষণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সমাজবিজ্ঞানীদের সম্পৃক্ততা : যে কোন রাষ্ট্রের সংবিধান সুষ্ঠুভাবে প্রণয়ন করতে হলে অথবা সংবিধানকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে সংবিধান রচয়িতাদের অবশ্যই সমাজস্থ মানুষের পারস্পরিক অবস্থা, ঐতিহ্য, বিরাজমান সামাজিক মূল্যবোধ এবং ধ্যানধারণাকে জানতে হবে। সুতরাং সংবিধান, শাসনতান্ত্রিক আইন, আইন পরিষদের কার্যকলাপ, প্রশাসন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বৃহত্তম সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করার জন্য সমাজবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই যে, সমাজবিজ্ঞানও সমাজস্থ মানুষের সামাজিক আচরণমূলক তথ্য সরবরাহ করে সামাজিক তাৎপর্য তুলে ধরে। আবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও সমাজবিজ্ঞানীকে রাজনৈতিক আচরণের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সরবরাহ করে। সেজন্য অনেকে মনে করেন একজন সমাজবিজ্ঞানী বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে একাধারে সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে হবে।
৪. সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সামঞ্জস্যতা : আধুনিককালে সমাজবদ্ধ মানুষের বহু বিচিত্র প্রয়োজন সাধনের জন্য রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কার্যকারিতা লক্ষণীয়; যেমন- সমাজ প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি, সামাজিক অনুশাসন প্রভৃতিকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র কোন আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে পারে না। সেজন্য প্রয়োজন মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে আমরা আমাদের সমাজে দেখতে পাই যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন, চোরাচালান, বর্ণ বৈষম্য, দাঙ্গা প্রকৃতি সমস্যাগুলো একদিকে যেমন সামাজিক অপরদিকে রাজনৈতিকও বটে। এসব সমস্যা সমাজবিজ্ঞানীদের যেমন আলোচনার বিষয় তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদেরকেও এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হয়। পরিশেষে বলা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের উপর সমাজবিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলে অনেক রাজনৈতিক আচরণকে স্বতন্ত্র করে বিবেচনা করা যায় না এবং সেই আচরণকে বৃহত্তর সমাজব্যবস্থারই একটি অঙ্গ বা বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করা হয়।