সমাজ কাঠামোর উপাদান
মানবগোষ্ঠীকে নিয়েই গঠিত হয় সমাজ। কিন্তু মানবগোষ্ঠীর কার্যকলাপ যখন পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ না হয় তখন সমাজ টিকে থাকতে পারে না। মানুষের কার্যকলাপের প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলো যত দৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয় ততই সমাজের ভিত মজবুত হয়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী সমাজে টিকে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে এ সকল প্রতিষ্ঠিত ধ্যানধারণা, কার্যকলাপ, সংগঠিত সমঝোতা ইত্যাদির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জিন্সবার্গ সমাজের প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলোর উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করে সমাজ কাঠামোর উপাদান হিসেবে সমাজের প্রধান প্রধান অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান ও দলকে চিহ্নিত করেছেন। বস্তুত সমাজ কাঠামোর উপাদান গুলো হচ্ছে মানুষের মৌলিক চাহিদার ভিত্তিতে গড়ে উঠা বিভিন্ন অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান ও দলসমূহ; যেমন- পরিবার ও বিবাহ, ভাষা, ধর্ম, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র ও সরকারি ব্যবস্থাপনা, সামাজিক বিধিবিধান ও মূল্যবোধসমূহ। নিম্নে এগুলো সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো:
১. পরিবার ও বিবাহ প্রথা (Family and Marriage System)
সমাজস্থ মানুষের বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে এবং অর্থনৈতিক যোগানের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবার ও বিবাহ প্রথা সমাজে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে বলে অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন। পরিবার ও বিবাহ প্রথার মাধ্যমে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক যোগান, জৈবিক বাসনা মিটানো, মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি কার্যাবলির সমাধান পরিবারভিত্তিক হয়ে থাকে। পরিবারের ভিত সুদৃঢ় থাকলে সামাজিক জীবনে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা টিকে থাকতে সহায়ক হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পরিবার ও বিবাহ প্রথা সমাজ কাঠামোর উপাদান হিসেবে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
২. ভাষা (Language)
ভাষা হচ্ছে সমাজ কাঠামোর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দিক। এটি হচ্ছে সংস্কৃতির ভিত্তি এবং চেতনার বাহন। কেননা সমাজস্থ মানুষের পারস্পরিক মনোভাব আদানপ্রদানের মাধ্যম হিসেবে ভাষা মৌলিক ভূমিকা পালন করে। সেজন্য সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং একই মনোভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষা সমাজ কাঠামোর অন্যতম উপাদান হিসেবে গুরুত্বারোপ করে।
আরও পড়ুন:
সমাজ কাঠামো কি? সমাজ কাঠামো কাকে বলে?
উপসংস্কৃতি কি? বিপরীত সংস্কৃতি বলতে কি বুঝ?
সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য কি কি?
৩. অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Economic Institution)
মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্যসহ অন্যান্য হাতিয়ার ও ব্যবহার সামগ্রীর প্রয়োজন। বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের অর্থনৈতিক যোগান বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। পারস্পরিক প্রয়োজন মিটানোর জন্য ভোগ, বণ্টন ও বিলি ব্যবস্থা, সম্পত্তি ও তার মালিকানার ধারণা ইত্যাদি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রয়োজন। এ সকল মৌলিক চাহিদা মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের আওতাধীন। কোন সমাজই এসবের বাইরে থাকতে পারে না। সেজন্য অনেকে মনে করেন যে, সমাজের মৌলিক ও অন্যতম প্রধান ভিত্তি হচ্ছে অর্থনীতি। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কার্ল মার্কস অর্থনীতির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে সমাজ কাঠামোর বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন।
৪. ধর্ম (Religion)
মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে এমন অনেক লৌকিক ও অলৌকিক ঘটনা পরিলক্ষিত হয় যে, তাতে অনেক রহস্য লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করা হয়। এসব রহস্য বুঝার ক্ষমতা সহজেই মানুষ লাভ করতে পারে না। ফলে মানুষের ভয়ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নানাবিধ জিজ্ঞাসা মনে জাগ্রত হয়। এসব প্রশ্নের উত্তর সহজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া মানুষের জন্মমৃত্যু, সুখদুঃখ, হাসিকান্না, বেদনা, হতাশা ও সুখের পরিতৃপ্তি ইত্যাদি থেকেই মানুষের চরম চাওয়া ও পাওয়ার উপলব্ধি জাগে। সেজন্য মানবজীবনের প্রাথমিক অবস্থা থেকেই মানুষের বিশ্বাস ও কাজাগতিক কার্যকলাপে ধর্মীয় চেতনার সৃষ্টি হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী Emile Durkheim দেখিয়েছেন যে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সমাজের সংহতি টিকে থাকে।
৫. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Political Institution)
সমাজস্থ মানুষের প্রাথমিক অবস্থা থেকেই জীবনব্যবস্থা দলপতির অনুসরণে করা হতো। তা থেকেই বুঝা যায় যে, আইন ও রাজনৈতিক সংগঠন সমাজ কাঠামোর অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুত্বারোপ করে। সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে আইন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিবর্তন ঘটেছে। ফলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজস্থ মানুষের অধিকার ও স্বাধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য * ইত্যাদি সমাজের অন্যতম উপাদান হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
৬. মনস্তাত্ত্বিক (Psychological)
মানবজীবনের চিন্তাধারা ও তার কর্মে অবসরে যেটুকু অবকাশ লাভ করার সুযোগ আসে তা থেকেই সে খুঁজে নেয় সমভাবাপন্ন সাক্ষীদের। সমাজে অবসর বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ক্রিয়ামূলক ব্যবস্থা রয়েছে। এ ক্রিয়ামূলক ব্যবস্থা দ্বারা সামাজিক মানুষের পারস্পরিক সংহতি গড়ে উঠে। সেজন্য মনস্তাত্ত্বিক দিকটিও সমাজ কাঠামোর উপাদান হিসেবে বিবেচ্য। তাছাড়া আমরা লক্ষ করতে পারি যে, মনস্তাত্ত্বিক কারণেই সমাজস্থ মানুষের গোষ্ঠীচেতনা গড়ে উঠে।
৭. সামাজিক গোষ্ঠী (Social Group)
যখন কতিপয় ব্যক্তি কোন বিশেষ সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনকল্পে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত হয় তখন সেই পারস্পরিক সম্পর্ককেই বলা হয় সামাজিক গোষ্ঠী। গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে ব্যক্তি বৃহত্তর সমাজের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে তোলে। সামাজিক জীবন মূলত গোষ্ঠী জীবনের মাধ্যমে গড়ে উঠে বিধায় একে সমাজ কাঠামোর উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৮. সামাজিক বিধিবিধানসমূহ (Social Rules and Regulations)
প্রত্যেক সমাজেরই কিছু নিয়মনীতি ও বিধিবিধান রয়েছে যার মাধ্যমে সমাজস্থ মানুষ = নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। সমাজের এ বিধিবিধানসমূহ সঠিকভাবে জানা না থাকলে সমাজকাঠামোর রূপকে সহজে উপলব্ধি করা যায় না। তাই একে সমাজ কাঠামোর উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৯. সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ (Social Norms and Values)
প্রতিটি সমাজের নিজস্ব আদর্শ ও মূল্যবোধ রয়েছে যার দ্বারা সমাজ পরিচালিত হয়। এগুলোর মাধ্যমে সমাজস্থ মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে বিধায় এগুলোকে সমাজ কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত মৌলিক প্রয়োজনগুলোর নিমিত্তে গড়ে উঠে প্রধান প্রধান অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীচেতনা। এসব প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর সংমিশ্রণের ফলে সমাজ টিকে থাকে। এগুলো সমাজ কাঠামোর অন্যতম উপাদান হিসেবে সমাজ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।