সরকারি ব্যয়
সরকার শাসনকার্য পরিচালনার জন্য এবং নানা প্রকার উন্নয়নমূলক ও জনহিতকর কাজের জন্য যে মুদ্রা ব্যয় করেন, তাই সরকারি ব্যয়। আধুনিককালে সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হয়েছে। ফলে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় করে। সরকারি অর্থব্যবস্থায় সরকারি ব্যয় দুই ধরনের হয়। যথা-
ক. কেন্দ্রীয় ব্যয় (Central Expenditure) ও
খ. স্থানীয় ব্যয় (Local Expenditure)।
ক. কেন্দ্রীয় ব্যয় (Central Expenditure)
কোনো দেশের সরকারের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় করা হয়, তাকে কেন্দ্রীয় ব্যয় বলা হয়। দেশ বা জাতির সার্বিক কল্যাণার্থে বা জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় সরকার যে ব্যয় করে, তাই কেন্দ্রীয় ব্যয়। দেশরক্ষা, সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ বাহিনী গঠন, বিচার বিভাগ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, জনকল্যাণ সাধন, সামাজিক নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি কাজে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ ব্যয় করে। সরকার বাজেট প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদনের পর বাজেটের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দকৃত ব্যয় হতেই কেন্দ্রীয় ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কর এবং বহির্ভূত রাজস্ব আয় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যয় সম্পন্ন করা হয়।
জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতি সমূহ আলোচনা কর |
খ. স্থানীয় ব্যয় (Local Expenditure)
স্থানীয় জনগণের কল্যাণার্থে স্থানীয় সরকার বিভিন্ন খাতে ব্যয় করে। স্থানীয় সরকার হলো জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, গ্রাম পরিষদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা প্রভৃতি। এ স্থানীয় সরকার স্থানীয় সমস্যাবলি সমাধানের জন্য যে ব্যয় করে, তাকে স্থানীয় ব্যয় বলে। স্থানীয় সরকারের কাজের প্রকৃতি মোটামুটি একই ধরনের হয়।
স্থানীয় সরকার উল্লিখিত বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করলেও বিবিধ কাজ সমাধা করে থাকে। অন্য যেসব খাতে ব্যয় করা হয় তা হলো-
i. কৃষি, বনায়ন, মৎস্য চাষ, গবাদি পশুপালন, কৃষি উন্নয়ন প্রভৃতি।
ii. আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
iii. বিনোদনের জন্য পার্ক, খেলার মাঠ, ক্লাব, নাট্যশালা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। iv. অনাথ আশ্রম স্থাপন ও পরিচালনা এবং মৃতদের সৎকার করার ব্যবস্থা করা।
সরকারি ব্যয়ের খাতসমূহ
আধুনিককালে পৃথিবীর সব দেশই অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন করছে। এ পরিকল্পনা কার্যকর করতে মুদ্রা ব্যয় করা হয়। বলা চলে, ব্যয় দ্বারাই সরকারি অর্থব্যবস্থা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সরকারি শাসনকার্য পরিচালনার জন্য এবং নানা প্রকার উন্নয়ন ও জনহিতকর কার্যের জন্য যে মুদ্রা ব্যয় করা হয়, তাই সরকারি ব্যয়। সরকার বিভিন্ন খাতে মুদ্রা ব্যয় করেন। সরকারি ব্যয়ের খাতসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো-
১. প্রতিরক্ষা: সরকারি ব্যয়ের প্রধান খাত হলো প্রতিরক্ষা খাত। এখানে সরকারি আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করা হয়। বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবিলা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। আধুনিক সমরাস্ত্র, প্রশিক্ষণ, বেতনভাতাদি প্রভৃতি বাবদ বিপুল পরিমাণ মুদ্রা প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হয়।
২. শিক্ষা: একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো শিক্ষা। শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি ছাড়া কোনো দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুষ্ঠু শিক্ষানীতির মাধ্যমে দেশে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি করা যায়। উন্নত দেশসমূহে শিক্ষার হার প্রায় শতকরা ১০০ ভাগ। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে শিক্ষার হার খুবই কম। তাই বর্তমানে শিক্ষাখাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
৩. সাধারণ প্রশাসন: সাধারণ প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত হলো স্বরাষ্ট্র, অর্থ, ডাক, তার, বাণিজ্য, খাদ্য, শিক্ষা, কৃষি, পুনর্বাসন প্রভৃতি বিভাগ। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা, উন্নয়নমূলক স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা প্রভৃতি বেসামরিক পর্যায়ে পরিচালিত কার্যাবলি নির্বাহের জন্য সরকারকে প্রচুর পরিমাণ কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করতে হয়। তাদের বেতনভাতা বাবদ বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ব্যয় হয়।
৪. স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে প্রচুর মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। হাসপাতাল প্রতিষ্ঠান, মহামারি প্রতিরোধ, বিভিন্ন ধরনের প্রতিষেধক, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবার পরিকল্পনা, ডাক্তারি ও নার্সিং শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি কার্যক্রম স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অন্তর্গত। এ খাতেও সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৫. পুলিশ প্রশাসন: অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা প্রদান প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য একটি দেশে পুলিশ বাহিনী অপরিহার্য। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য একটি শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী প্রয়োজন হয়। তাই এখানে সরকারকে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।
৬. বিচার ও কারা বিভাগ: বিচার বিভাগ ও কারা বিভাগের জন্য সরকারকে প্রতিবছর যথেষ্ট পরিমাণে মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। এ বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনাদি ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ যেমন- কারাগার রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন সাধন, বন্দিদের চিকিৎসা, খাদ্য ইত্যাদির ব্যবস্থাকরণ প্রভৃতির জন্য বিপুল, পরিমাণ মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।
৭. রাজস্ব আদায়কারী বিভাগ: রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারের অনেক বিভাগ রয়েছে। যেমন- আয়কর বিভাগ, বাণিজ্য শুল্ক বিভাগ, আবগারি শুল্ক বিভাগ, ভূমি রাজস্ব প্রভৃতি রাজস্ব আদায়কারী বিভাগসমূহের ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারকে যথেষ্ট পরিমাণ মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।
৮. ঋণ ও সুদ পরিশোধ: সরকার বিভিন্ন উদ্দেশ্যে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস ঋণ গ্রহণ করে। গৃহীত ঋণ পরিশোধ করতে হয় এবং তার সুদও প্রদান করতে হয়। তাই গৃহীত ঋণ ও তার সুদ পরিশোধের জন্য সরকারকে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।
৯. বৈদেশিক বিষয়াবলি: বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন, প্রতিষ্ঠিত সম্পর্কের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বিভিন্ন দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ প্রভৃতি বহুবিধ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন দেশে দূতাবাস স্থাপন করে থাকে। ফলে এ খাতে প্রচুর মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।
১০. অবসর ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবসর ভাতা ও বিধি মোতাবেক অন্যান্য সুবিধাদি প্রদান করতে হয়। অবসরপ্রাপ্ত এ. কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য সরকার প্রচুর মুদ্রা ব্যয় করে।
১১. সাহায্য ও মঞ্জুরি: অনেক সময় ট্রেন, বাস, নৌযান, বিমান প্রভৃতি দুর্ঘটনাজনিত কারণে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। তাছাড়া সরকার বিভিন্ন সময় অসহায় ব্যক্তিবর্গকেও আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে। এর ফলে সরকারের প্রচুর মুদ্রা ব্যয় হয়।
১২. সমাজকল্যাণ কার্যাবলি: সরকার সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে। সরকার জনকল্যাণ ও চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে পার্ক, স্টেডিয়াম, চিড়িয়াখানা, পর্যটন কেন্দ্র ইত্যাদি নির্মাণ ও পরিচালনা করে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ব্যয় করে।
জাতীয় আয় পরিমাপের সমস্যা সমূহ আলোচনা কর |
১৩. হিসাব নিরীক্ষা: দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। কাজেই সরকার প্রতিবছর নিরীক্ষা খাতে মুদ্রা ব্যয় করে।
১৪. অপ্রত্যাশিত ব্যয়: বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকার জরুরি ভিত্তিতে সাহায্য প্রদান করে। অপ্রত্যাশিত ব্যয়ের জন্যও সরকার প্রচুর মুদ্রা ব্যয় করে।
১৫. জনকল্যাণমূলক কাজ: জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য সরকার প্রতিবছর প্রচুর মুদ্রা ব্যয় করে। যেমন- বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, বেকারভাতা প্রদান, পেনসন প্রদান প্রভৃতি জনকল্যাণমূলক কাজে প্রচুর মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।
১৬. মৌলিক চাহিদা পূরণ: বিশ্বের অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অতিমাত্রায় বেড়ে চলেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সরকারকে প্রচুর মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।
১৭. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: বর্তমানে প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকারকে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হয়। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যত বিস্তৃত হবে, সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ তত বৃদ্ধি পাবে।