Home » সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা

সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা

by Rezaul Karim
সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা

নিম্নে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহন হিসেবে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করা হলো:

সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিবারের ভূমিকা

পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের তাৎপর্যপূর্ণ বাহন। এর প্রধান কাজ হলো শিশুকে সৎ আচরণ এবং নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা দেওয়া। পারিবারিক সুন্দর পরিবেশে শিশু যা গ্রহণ করে অন্য কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে সে তা করে না। শিশুকে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র হলো সুগঠিত পরিবার। বস্তুত ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক, সৎ-অসৎ ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিবার নামক অনানুষ্ঠানিক বিদ্যাগৃহেই শিক্ষা দেওয়া হয়। অর্থাৎ একটি শিশুর সকল সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া গঠনে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম।

সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহন সমূহ আলোচনা কর

সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবে পরিবার নিম্নোক্ত ভূমিকা পালন করে:

প্রথমত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আদর্শ অনুযায়ী সমাজের সদস্য হিসেবে কোন ব্যক্তিকে গড়ে তুলতে পরিবারই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতি অর্জনের লক্ষ্যে ব্যক্তিকে সমাজ আকাঙ্ক্ষিত ধারায় প্রবাহিত করতে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

তৃতীয়ত, ব্যক্তির হীন স্বার্থকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং খারাপ পথ তথা ধ্বংসের হাত থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করতে ও সংশোধন করতে পরিবার একটি উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান।

চতুর্থত, পরিবার সমাজজীবনের ভিত্তিস্বরূপ। এখানেই শিশুর ভবিষ্যতের প্রস্তুতি সম্প্র করে। পারিবারিক পরিবেশেই শিশু ন্যায়-অন্যায় এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যটা অনুধাবন করতে পারে।

পঞ্চমত, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা থেকে সামাজিক বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হয়। সুতরাং সমাজিক শৃঙ্খলা এবং আদর্শ ও মূল্যবোধকে ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় পারিবারিক কাঠামো।

সামাজিক নিয়ন্ত্রণে ধর্মের ভূমিকা

প্রাচীনকালে সমাজে আচার-আচরণ ছিল ধর্মভিত্তিক। তখন ধর্ম সমজিক আচার ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে একটি প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতো।

আদিম সমাজেও ধর্মকে কেন্দ্র করে সামাজিক আচার-আচরণ প্রথা গড়ে উঠেছে। এর মূল কারণ হলো, ধর্ম মানুষের সাথে মানুষের নানা প্রকার কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা ও সংযোগ সৃষ্টি করে। সেজন্য সামাজিক জীবনের নানা প্রকার জটিলতার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধিবিধান যেমন অনুসরণ নীতি হিসেবে কাজ করে, তেমনি মানুষ যখন সহজসরল বিচারবুদ্ধিতে যেখানে বিভ্রান্ত বা দিশেহারা হয়ে পড়ে সেখানে ধর্ম জীবন চলার পথে আলোকবর্তিকার ন্যায় কাজ করে। তাছাড়া ধর্মীয় চিন্তাধারার সাথে অতিপ্রাকৃত শক্তির চিন্তাধারা সম্পৃক্ত থাকার ফলে মানবমনে ধর্মীয় বিধিনিষেধের প্রতি ভয়ভীতি ছিল। অর্থাৎ পরকালের একটা বিধিবদ্ধ ধারণা মানুষকে সর্বদা একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করতো। সেজন্য ধর্মের প্রভাব সমাজস্থ মানুষের মনে যত বেশি পড়ে ততই সে সমাজে পাপকার্য কম সংঘটিত হয়। এতে যেমন সামাজিক মানুষ উপকৃত হয়, পক্ষান্তরে তার মনে সন্তুষ্টি জন্মে যে, পরকালেও সে এর ফলশ্রুতি হিসেবে স্বর্গবাসী হবে।

সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কি | সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে

সমাজের আদিকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত ধর্মীয় বিধিবিধান মানুষকে প্রভাবিত করেছে। কারণ রহস্যময় প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে মানুষ নিজেকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে যেমন আগ্রহী, তেমনি সামাজিক জীবনের নিয়ামক হিসেবে ধর্মীয় কতকগুলো চিন্তাধারা সমাজকে সঠিকভাবে পরিচালনার পক্ষে সহায়ক। সেজন্য ধর্মীয় চিন্তাধারা অতিপ্রাকৃত শক্তির উপর বিশ্বাস স্থাপন করা সত্ত্বেও এর একটা সামাজিক মূল্য রয়েছে। সামাজিক মানুষের মাঝে সংহতি রক্ষা প্রত্যেক ধর্মের বিধিবিধানেই স্বীকৃত।

সামাজিক জীবনে ধর্মীয় বিশ্বাস প্রগাঢ়ভাবে কার্যকর থাকার ফলেই মধ্যযুগে নতুন চিন্তাধারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। ফলে মধ্যযুগে মানুষের স্বাধীন চিন্তাধারা ব্যাহত হতো ও সামাজিক চিন্তাধারার মধ্যে রক্ষণশীলতার মনোভাব দেখা যেত।

সমাজ ও সংস্কৃতি বিকাশের ধারায় ধর্মীয় চিন্তাধারায়ও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সেজন্য বর্তমানে ধর্মীয় আবেগের স্থলে মানুষের নতুন ভাবধারার জন্ম হয়েছে। ফলে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সুবিধাবাদী ধারণাগুলো অনেক ক্ষেত্রে দূর হয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইমের মতে, ধর্মের প্রধান কাজ সামাজিক ঐক্য বা সংহতিকে সুদৃঢ় করে তোলা। সামাজিক জীবনে আমরা এ কথার তাৎপর্য লক্ষ্য করি; যেমন- আমরা দেখতে পাই যে, ধর্মীয় আচার-উৎসবের মধ্যে একটা সামাজিক সংহতি লক্ষণীয়। কারণ এসব আচার-অনুষ্ঠানের মাঝে একটা পবিত্রতা আছে, একটা দিব্য আছে, সেজন্য সকলে আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সংহতি বজায় রাখার প্রয়াস পায়। তাই দেখা যায় যে, পৃথিবীর সব শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থই সমাজ দেহের মেরুদণ্ডস্বরূপ।

তাছাড়া প্রকৃত ধার্মিক লোক নৈতিক আদর্শ দ্বারা পরিচালিত। ফলে ধার্মিক ব্যক্তি স্বভাবতই বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি যিনি নীতিসম্মতভাবে তার কর্তব্য সম্পাদন করেন এবং নৈতিক আদর্শকে অনুসরণ করে তার জীবনযাপনের সংকল্প গ্রহণ করেন। এরূপ ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সামাজিক দুর্নীতি দূর হয় এমনকি সামাজিক বিশৃঙ্খলাও আসে না।

বর্তমানকালে ধর্মীয় চিন্তাধারা মানবমনে অনেক প্রশান্তি এনে দেয়। এর মূল কারণ হলো, প্রত্যেক ধর্মীয় ধারণায় সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত। এ চিন্তাধারা মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ সাধন করে এবং সমাজে পরস্পরকে করে তোলে একই মনোভাবাপন্ন। সামাজিক জীবনে এরূপ নিয়ন্ত্রণ তাৎপর্যপূর্ণ। সেজন্য ধর্ম বিভিন্নস্থানে বিভিন্নরূপে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সংস্থা হিসেবে আজও যে শক্তিশালী মাধ্যম রূপে কাজ করে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

অতএব, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা সম্পর্কে ‍সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে সক্ষম হলেন।

Related Posts