সামাজিক পরিবর্তনের তত্ত্ব সমূহ
সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব বা মতবাদ রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি সামাজিক পরিবর্তনের তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. সরোকিনের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের নীতি
সরোকিন মনে করেন যে, সমাজের বাহ্যিক কারণ ছাড়াও কতকগুলো অভ্যন্তরীণ কারণে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। তা বিশেষ করে নির্ভর করে সামাজিক মূল্যবোধের উপর। তিনি মনে করেন যে, সামাজিক পরিবর্তনের বীজ অন্তর্নিহিত রয়েছে সামাজিক ঘটনাগুলোর মধ্যে। তাঁর এ মতবাদ বাহ্যিক সামাজিক পরিবর্তনের মতবাদের ঠিক উল্টো পথ।
সমাজের রূপান্তরের সাথে সাথে সমাজ সংস্কৃতির রীতিনীতিরও পরিবর্তন হয়ে থাকে। এ মতবাদ অনুযায়ী দেখা যায় যে, সমাজে বাহ্যিক পরিবেশগুলো পরিবর্তনের কারণগুলোর দ্বিতীয় পর্যায় বলে মনে করা যেতে পারে। সরোকিন আরো স্পষ্ট করে বলেন যে, সমাজের অন্তর্নিহিত পরিবর্তনে যারা বিশ্বাসী তারা সামাজিক কারণগুলোর মূল সূত্র অনুধাবন করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ডাক্তার প্রথমে তার নিয়মগুলো অধ্যয়ন করে দেখেন যে, কোন কোন অন্তর্নিহিত কারণগুলোর জন্য রোগের সৃষ্টি হয়েছে এবং সে অনুযায়ী তিনি এর কারণ উদ্ভাবন করে থাকেন।
সেরূপ সামাজিক পদ্ধতির মধ্যেও সামাজিক পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত কারণ প্রথমে কাজ করে থাকে এবং তা পরে সমাজের কাঠামোতে বিকাশ লাভ করে। তিনি সমাজের কতকগুলো উপাদানের ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেন।
সামাজিক পরিবর্তনের কারণ সমূহ আলোচনা কর |
সামাজিক পরিবর্তনের তিন প্রকার মতবাদ রয়েছে; যেমন- রৈখিক মতবাদ, চক্রাকার মতবাদ ও পৌনঃপুনিক মতবাদ। এগুলোর মধ্যে যেখানে অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছে তাকেই তিনি সামাজিক পরিবর্তনের মূল উপাদান বলে মনে করেছেন।
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, পরিবর্তনের মূলে অভ্যন্তরীণ কারণ ও বাহ্যিক কারণ রয়েছে এবং যেখানে অভ্যন্তরীণ কারণ মুখ্য কাজ করে তাকেই সরোকিন সামাজিক কারণ বলে অভিহিত করেন। সরোকিনের এ মতবাদের সাথে সামাজিক পরিবর্তনের ক্রিয়াশীল মতবাদের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় এবং এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে।
২. সামাজিক পরিবর্তনের কার্য সম্বন্ধীয় মতবাদ
১৯৩৫ সালে প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী রেডক্লিফ ব্রাউন মনে করেন যে, পরস্পর সম্পর্কিত কতকগুলো খণ্ডের একত্রীকরণেই সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি এবং প্রত্যেক খণ্ড কতকগুলো স্বতন্ত্র কার্য সম্পন্ন করে থাকে যা ব্যক্তি বা সমাজজীবনের জন্য একান্তভাবে প্রয়োজনীয়।
যে যে কার্যের উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্তিত্বগুলোর সমন্বয় হয়ে থাকে এবং যার দ্বারা একটি জীবনপ্রণালী গড়ে উঠে সে কার্যকেই প্রণালী বলে।
উপরিউক্ত ধারণা থেকে দেখা যায় যে, সামাজিক পরিবর্তন কার্যপ্রণালীর দ্বারাই হয়ে থাকে। কারণ ব্যক্তির বা দলের কার্যের সমন্বয়ই হলো সামাজিক জীবন। সুতরাং ব্রাউন মনে করেন যে, সামাজিক পরিবর্তন ব্যক্তির কার্যের উপর নির্ভরশীল।
রেডক্লিফ ব্রাউনের এ মতবাদ বিশেষ করে সমাজে ব্যক্তির টিকে থাকার তাগিদের ব্যাপারে গণ্য করা যেতে পারে। এ মতবাদের বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে নৃতত্ত্ববিদ ব্রোনিস্ল মেলিনোস্কী মনে করেন যে, সমাজের এ কার্যকলাপ ধারণার বিশেষত্ব হচ্ছে সমাজের রীতিনীতির বাস্তব রূপায়ণের জন্য। কিন্তু দীর্ঘকাল যাবৎ কার্য সম্বন্ধীয় মতবাদ সমাজবিজ্ঞানিগণ এক্ষেত্রে ব্যবহার কর এসেছেন। যখন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও বিষয়াদি দ্বারা কার্য সম্পন্ন করে সমাজ নতুন আকারে রূপান্তরিত হতে লাগল তখন আধুনিক মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ট্যালকট পারসন ও আর. কে. মার্টনের হাতে এ পদ্ধতি নতুন জীবন লাভ করে এবং তাঁরা সমাজকাঠামোর পরিবর্তনের সাথে সাথে যে সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব এ ধারণায় একমত হন। অবশ্য পরে তাঁরা সামাজিক কার্যকারিতাকে একটি বিশেষ নমুনা বা ‘Model’ হিসেবে বিশ্লেষণ করেন।
তাছাড়া যখন সমাজবিজ্ঞানিগণ মনে করলেন যে, সামাজিক পরিবর্তন সমাজকাঠামোর পরিবর্তনের সাথে পাশাপাশি কাজ করে, তখন তাঁরা এ ধারণার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
সামাজিক পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য সমূহ কি কি? |
আমরা জানি যে, সমাজে ব্যক্তির দ্বারা কাজ সম্পন্ন হতে পারে বা কোন দলের সমন্বয়েও কাজ সম্পন্ন হতে পারে। যখন সমাজে পারস্পরিক একটি সুনির্দিষ্ট রীতিনীতির দ্বারা পরিচালিত হয় তখন তাকে পদ্ধতি বলা হয় এবং সামাজিক পরিবর্তন সামাজিক পদ্ধতির দ্বারা হতে পারে। আবার পদ্ধতির অন্তর্গত রীতিনীতিরও পরিবর্তন হতে পারে, যাকে আমরা বলে থাকি ‘Change of system’ এবং ‘Change within the system’- এর অর্থ হচ্ছে গোটা পদ্ধতির পরিবর্তন হতে পারে আবার পদ্ধতির অন্তর্গত যে কোন রীতিনীতিরও পরিবর্তন হতে পারে।
৩. রাল্ফ লিনটনের সামাজিক পরিবর্তনের মতবাদ
রাল্ফ লিনটনের সংস্কৃতির পরিবর্তনে দেখা যায় যে, সংস্কৃতির প্রসারতাই সামাজিক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। সংস্কৃতির প্রসারতা বলতে আমরা বুঝে থাকি অন্যান্য সংস্কৃতির বা সমাজের রীতিনীতির সংযোজন। তার ফলে যে নতুনত্ব দেখা যায় তাতে সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই রদবদলের সৃষ্টি হয়ে থাকে এবং এর ফলে সমাজে অনেক দিক দিয়েই পরিবর্তন ঘটে।
রাল্ফ লিনটনের মতে সংস্কৃতির প্রসারতার দু’টি কারণ রয়েছ। প্রথম কারণ হচ্ছে, এক সংস্কৃতি হতে অন্য সংস্কৃতির রীতিনীতি ও সমাজের বিভিন্ন উপাদানের আদানপ্রদানের প্রয়োজনীয়তা। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, যেসব উপাদান অন্য সংস্কৃতি থেকে এ সংস্কৃতিতে আনা হচ্ছে তার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে নিজস্ব সংস্কৃতির নতুনত্ব সৃষ্টি করা। যখন সামঞ্জস্য রক্ষা হয় তখন সে সংস্কৃতির কিছু অর্জন ও বর্জন হয়ে থাকে। এ আদানপ্রদানের ফলে তখন সমাজে পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। এছাড়াও সমাজের এ আদানপ্রদানের ফলে যে গতিশীলতার সৃষ্টি হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রভাবের উদ্ভব হয় তাকে বিসর্পণ গতি বলা হয়। লিনটন বিসর্পণ গতির বিশ্লেষণ করে বলেন যে, “সংস্কৃতির অন্যান্য দিক ঠিক থেকে সংস্কৃতিতে যে নতুন কিছুর আবির্ভাব ঘটে- প্রথমে তা গ্রহণ করে এবং পুরাতনের কিছুটা রদবদল ঘটে থাকে এবং তারপর উভয় সংস্কৃতির মাঝে একটা পরিবর্তনের মাধ্যমে সামঞ্জস্য রক্ষা করে নতুন রূপের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
তিনি বলেন যে, সমাজের মাঝে এ বিসর্পণ গতি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে হয়ে থাকে এবং নানারকম সামাজিক কারণে এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
সামাজিক পরিবর্তন কাকে বলে | সামাজিক পরিবর্তন কি |
সংস্কৃতির বিসর্পণের ফলে সামাজিক দিক থেকে অনেক ক্ষেত্রেই অনগ্রসরতা দেখা দেয় এবং নতুন প্রভাবের ফলে পুরাতনের মাঝে অনেক ক্ষেত্রেই অসামঞ্জস্যতার সৃষ্টি হয়ে থাকে। লিনটন সামাজিক বিসর্পণ গতিকে সামাজিক পরিবর্তনের একটা কারণ মনে করেন।
আমরা উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা সামাজিক পরিবর্তনের কয়েকটি মতবাদ আলোচনা করছি। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তন সম্বন্ধে এতো বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে যে, প্রত্যেক মতবাদ পৃথক পৃথক করে বিশ্লেষণ করে সামাজিক পরিবর্তনকে সমাজতাত্ত্বিক অধ্যয়নের আওতায় এনে গুরুত্ব নির্ণয় করা কষ্টসাপেক্ষ। আমরা সামাজিক পরিবর্তনকে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ দিয়ে আলোচনার প্রাধান্য বিচার করে সামাজিক পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে সামাজিক পরিবর্তনের তত্ত্ব সমূহ সম্পর্কে জানতে পারলেন।
1 comment
[…] সামাজিক পরিবর্তনের তত্ত্ব সমূহ আলোচন… […]
Comments are closed.