সামাজিক মূল্যবোধ
আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানে সামাজিক মূল্যবোধ বা মূল্যমানের আলোচনার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। গোষ্ঠী জীবনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো সামাজিক মূল্যবোধ । এ মূল্যবোধের দ্বারা গোষ্ঠীর সদস্যদের আচার ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয়। এ মূল্যবোধই হলো গোষ্ঠীর জীবনধারার মান।
সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানে ‘মূল্যবোধ’ প্রত্যয়টি দ্বারা সাংস্কৃতিক আদর্শের (Cultural standards) কথা বলা হয়। এসব সাংস্কৃতিক আদর্শের দ্বারা সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মনোভাব, প্রয়োজন ও বঞ্চিত বস্তুর যৌক্তিক, নান্দনিক ও নীতিগত প্রাসঙ্গিকতা যাচাই করা যায়।
প্রকৃতপক্ষে, মূল্যমান হচ্ছে এক ধরনের বিশ্বাস অথবা নৈতিক অনুজ্ঞা, যার দরুন কোন চূড়ান্ত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে উৎকৃষ্ট, কাম্য এবং অনুসরণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কার্যত কোন প্রচেষ্টা চলেছে কি না তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের উৎকর্ষতা এবং বাঞ্ছনীয়তা সম্পর্কে একটা আন্তরিক বিশ্বাস। দেশ ও সমাজভেদে নৈতিক অনুজ্ঞা, মানুষের বিশ্বাস, প্রত্যয় বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে বলে মূল্যমানের ক্ষেত্রেও বিভিন্নতা দেখা যায়। একথা ঠিক, অধিকাংশ সমাজেই মানুষের স্বীকৃত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও পারস্পরিক আচরণ মোটামুটি একই ধরনের। কিন্তু একটি সমাজের সাথে আর একটি সমাজের পার্থক্য তখনই স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন দেখা যায় যে, ঐ সকল চরিত্রগত গুণকে এক একটি সমাজ তার সাংস্কৃতিক মান অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ, স্বল্প গুরুত্বপূর্ণ, উৎকৃষ্ট কিংবা নিকৃষ্ট প্রভৃতি বিভিন্ন তারতম্যমূলক অর্থে গ্রহণ করে নিচ্ছে। কোন সমাজ আক্রমণাত্মক মনোভাবকে মূল্য দিয়ে অপ্রতিরোধী মানসিকতাকে নিন্দা করে। কোন সমাজ বিপরীতভাবে অপ্রতিরোধী মানসিকতাকেই প্রাধান্য দেয় এবং আক্রমণাত্মক মনোভাবকে অন্ধ আদিমতা বলে ধিক্কার জানায়। আবার কোন সমাজের সাংস্কৃতিক চিন্তাধারার ঐ উভয় গুণই গুরুত্ববিহীন। সেখানে আবেগ প্রবণতার পরিবর্তে প্রত্যয়শীল চিন্তাভাবনা চারিত্রিক গুণ হিসেবে স্বীকৃত। পাশ্চাত্য সমাজে বস্তুতান্ত্রিকতা অন্যতম প্রধান মূল্যমান। অন্যপক্ষে, ভারতীয় সমাজে আধ্যাত্মিকতা অদ্যাবধি শীর্ষ স্থানীয় মূল্যমান।
তবে একথার অর্থ এই নয় যে, পাশ্চাত্যের সমাজ ও সংস্কৃতিতে আধ্যাত্মিকতার কোন স্থান নেই। অপরদিকে, ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে পার্থিব অগ্রগতিরও কোন ৫ গুরুত্ব নেই। আসলে এ বিষয়টি আপেক্ষিক। উভয় ধরনের সমাজ ও সংস্কৃতিতে মূল্যবোধের উক্ত দ্বিবিধ বৈশিষ্ট্য কমবেশি বিদ্যমান। আবার জীবন দর্শনের পরিবর্তনের ১) সাথে মূল্যমানও বদলে যায়। আজকের দিনে আমাদের কাছে যা মূল্যমান তা হয়তো বই একদা নিন্দনীয় ছিল এবং আজকে যা আমাদের অবজ্ঞার বিষয় তা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এক সময় মূল্যমান হিসেবে গণ্য হতে পারে। বস্তুত নতুনের সংযোজন নিয়েই মূল্যমানের চিরায়ত বা শাশ্বত পরিচিতি।
আরও পড়ুন: ঐতিহাসিক পদ্ধতি কি? ঐতিহাসিক পদ্ধতির গুরুত্ব আলোচনা কর