আজকের ব্লগে আলোচনা করবো- সামাজিক সমস্যা কি, সামাজিক সমস্যা কাকে বলে, সামাজিক সমস্যা বলতে কি বুঝ বা সামাজিক সমস্যা বলতে কি বুঝায়, সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা এবং কয়েকটি সামাজিক সমস্যা উদাহরণ দেবো।
সামাজিক সমস্যা কি বা কাকে বলে?
আমরা জানি যে, যা সমাজের সামগ্রিক মঙ্গলের পরিপন্থি বলে গণ্য করা হয়ে থাকে, তাকেই সামাজিক সমস্যা বলে মনে করা হয়। সমাজস্থ লোকের ধ্যানধারণা ও ভাবনা-কল্পনার সাথে ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের মান পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। সেজন্য সময়ভেদে ও স্থানভেদে সামাজিক সমস্যার প্রকৃতিতে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়; যেমন- প্রাচীনকালে সমাজব্যবস্থাতে যা সমস্যা বলে ধারণা করা হতো না আজ তা করা হচ্ছে।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কি | সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে |
পক্ষান্তরে, একটি নির্দিষ্ট সমাজব্যবস্থায় যা সমস্যা বলে মনে করা হয় না, তা আজ আমাদের বিচারের মানদণ্ডে সমস্যা বলে পরিগণিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি যে, গ্রিক ও রোম সমাজে দাসপ্রথার প্রবর্তন করে যান্ত্রিক উপায়ে অভাবজনিত সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে মানুষের ধ্যান-ধারণা পরিবর্তিত হবার ফলে দাসপ্রথা একটা সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আবার পাশ্চাত্য উন্নতশীল সমাজে দারিদ্র্য বলতে যে অর্থ বহন করে, আমাদের মতো অনুন্নত দেশে ঠিক সে অর্থ বহন করে না। সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন সমাজে একই সমস্যার প্রকৃতি পৃথক হতে পারে। সেজন্য সামাজিক সমস্যা, আলোচনাকালে সামাজিক সমস্যার সঙ্গে সমাজস্থ লোকের পারস্পরিক সম্বন্ধ এবং প্রচলিত জীবনধারাগত আদর্শ বা মূল্যবোধ জানতে হবে।
কাজেই প্রতিষ্ঠিত সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধের সাথে সমস্যার মান নির্ণীত হয়ে থাকে এবং সামাজিক মানুষের ক্রিয়াকর্মের পার্থক্য ঘটে। কাজেই প্রত্যেক সমাজে সমস্যা সৃষ্টি হবার মূলে সামাজিক পটভূমি থাকে। সমাজের প্রতিষ্ঠিত আচার ব্যবস্থা ও আদর্শ দ্বারা এ সমস্যা নিরূপিত হয় বলে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক সমস্যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার হয়ে থাকে।
সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা
শব্দগত অর্থে ইংরেজি ‘Problem’ শব্দের বাংলা পরিভাষা হচ্ছে সমস্যা। গ্রিক শব্দ ‘Problema’ থেকে ইংরেজি ‘Problem’ শব্দটি এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে, এমন একটি নিক্ষেপিত ঘটনা, যা সমাজস্থ ব্যক্তি বা সমষ্টির ধ্যান-ধারণার উপর বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করার একটা চাপ সৃষ্টি করে। মানুষ যখন তার সামাজিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অনিবার্য প্রয়োজন পূরণ করার ক্ষেত্রে নিক্ষেপিত একটা ঘটনা দ্বারা নানাবিধ অন্তরায়ের সম্মুখীন হয়, তখন তা সমস্যারূপে পরিগণিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী নিস্বেট (Nisbet) এবং মার্টন (Merton) তাঁদের ‘Contemporary Social Problems’ নামক বইয়ে উল্লেখ করেন যে, সামাজিক সমস্যা সমাজের অন্তর্ভুক্ত লোকের পারস্পরিক সম্বন্ধ এবং প্রচলিত জীবনধারাগত আদর্শ বা মূল্যবোধ জড়িত থাকার কারণে ‘সামাজিক’ শব্দ দ্বারা সমস্যাকে বিশ্লেষণ করেন।
সাধারণ অর্থে সমস্যা বলতে বুঝায় আকাঙ্ক্ষিত অবস্থার অস্বাভাবিকতা বা অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতি বা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর একটি বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী সামাজিক সমস্যাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। সেজন্য সামাজিক সমস্যার একটি নির্দিষ্ট সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা পাওয়া কঠিন। সমাজবিজ্ঞানী লরেন্স কে. ফ্রাঙ্ক (L. K. Frank) সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “যে কোন অসুবিধা বা অসদাচরণ যা সমাজবাসীর এক বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে এবং যার সংশোধনের জন্য আমরা সচেতন, তাকে সামাজিক সমস্যা বলে।” উক্ত সংজ্ঞায় মানুষের আচরণের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সমাজবাসীর একটি নির্দিষ্ট মূল্যবোধের ব্যতিক্রমধর্মী আচরণ প্রদর্শিত হলে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হবে।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা |
সমাজবিজ্ঞানী পি. বি. হর্টন এবং জিরাল্ড আর লেসলী (P. B. Horton and J. R. Lesley) তাঁদের “The Sociology of Social Problem’ গ্রন্থে সামাজিক সমস্যাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “সমাজজীবনের এমন একটি অবস্থা যা সমাজবাসীর বৃহৎ অংশকে আক্রান্ত করে, যা অবাঞ্ছনীয় মনে করা হয় এবং যার প্রতিকারের জন্য সমাজবাসী সচেতন এবং দলগত প্রচেষ্টায় এর প্রতিকার সম্ভব। “২
ই. র্যাব এবং জি. জে. সেল্জনিক (E. Rabb and G. J. Selznick) সামাজিক সমস্যার আরো ব্যাপক সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাঁদের মতে, “Rabb and Selznick say that this is a problem in human relationships which seriously threatens society itself or impedes the important aspirations of many people.”” অর্থাৎ, মানুষের সম্পর্ক থেকে সৃষ্ট একটি সমস্যা যা প্রচণ্ডভাবে সমাজকে আঘাত করে বা বহু লোকের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশাকে ব্যাহত করে। তাঁরা আরো বিশদ বিশ্লেষণ করে বলেন যে, যখন এমন কোন অবস্থার সৃষ্টি হয় যা সমাজের সংগঠনকে অকর্মণ্য করে তোলে, যার দ্বারা ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্কে ভাঙন সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তী বংশধরদের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাকে সামাজিক সমস্যা বলে।
অনেক সমাজবিজ্ঞানী সামাজিক সমস্যাকে সামাজিক রোগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ এর দ্বারা সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে; সমাজের সংহতি বিনষ্ট হয়। আবার অনেকে সামাজিক সমস্যাকে সমাজের বিশৃঙ্খলতা বলে উল্লেখ করেন এবং এ ধারণায় প্রায় সকলেই একমত যে, সামাজিক সমস্যা সমাজব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা থেকে উদ্ভূত।
কয়েকটি সামাজিক সমস্যা উদাহরণ হলো- বেকারত্ব, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি।