সামাজিক স্তরবিন্যাস
সামাজিক স্তরবিন্যাস বলতে সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণীর উচ্চ নীচ অস্থান বিন্যাসকে বুঝায়।
আমাদের চারপাশে উপস্থিত মানুষের সমাজের মানুষের প্রকৃতি বৈষম্যমূলক। এখানে যেমন রয়েছে ধনী, দরিদ্র তেমনি রয়েছে শিল্পপতি, ভূস্বামী ও কৃষক। আবার এ সমাজেই শাসক বা প্রভু এবং শাসিত ভৃত্যরাও রয়েছে। প্রত্যেক সমাজেই অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সংমিশ্রণ রয়েছে। সমাজের গঠনের মধ্যেই মানুষে মানুষে এ বৈষম্য গভীরভাবে প্রোথিত আছে।
আলোচন্য সামাজিক স্তরবিন্যাস প্রত্যয়টি মূলত সমাজের মানুষকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করার নির্দেশ করে। আদিকাল থেকেই মানব সমাজে স্তরবিন্যাস প্রচলিত ছিল। কিন্তু আদিম সমাজে সামাজিক স্তরবিন্যাস ছিল সহজসরল প্রকৃতির। মানব সভ্যতার ক্রমোন্নতির সাথে সাথে সামাজিক স্তরবিন্যাসও ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর রূপ ধারণ করেছে।
সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা
সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে কে. সি. মেয়ারস তাঁর, “Class and Society” গ্রন্থে বলেন যে, “Social Stratification is a system of differentiation which includes hierarchy of social positions whose occupants are treated as superior, equal or inferior relative to one another in socially important respects.” অর্থাৎ, সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো সামাজিক পদমর্যাদার দিক থেকে সমাজের মানুষকে উচ্চ, সমান ও নীচু ইত্যাদি স্তরে ভাগ করা।
সমাজবিজ্ঞানী এইচ. আর. রস তাঁর “Perspective on the Social Order” গ্রন্থে সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞায় বলেন, “Stratification refers to the differential ranking of status where by some are considered higher and others lower.” অর্থাৎ, স্তরবিন্যাস হচ্ছে মর্যাদার বিভিন্ন স্তর যেখানে কেউ উঁচুতে অবস্থান করে এবং অন্যান্যরা নীচুতে অবস্থান করে।
আরও পড়ুন: নগর সমাজবিজ্ঞান কাকে বলে? নগর সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
সমাজবিজ্ঞানী স্প্র্যাডলি ও ম্যাকার্ডি তাঁর “Anthropology” গ্রন্থে বলেন যে, “Social stratification exists when people regularly experience unequal access to valued economic resources and prestige.” অর্থাৎ, সামাজিক স্তরবিন্যাস এর অস্তিত্ব তখনই লক্ষ্য করা যায় যখন অর্থনৈতিক সম্পদ ও মর্যাদার দিক থেকে জনগণের মধ্যে অসম অধিকার বিরাজ করে।
সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য
সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য সমূহ নিচে আলোচনা করা হলো-
১) স্তরবিন্যাস হলো সামাজিক
সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো মানবিক সম্পর্কের স্তরবিন্যাস। ঐ স্তরবিন্যাস সামাজিক মান ও রীতির নিয়ামক। সামাজিক মান বা রীতি সামাজিক স্তরবিন্যাসের মাধ্যমে বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হয়। এ কথা সত্য যে, ক্ষমতা, মর্যাদা, বুদ্ধিমত্তা, বয়স, লিঙ্গ ইত্যাদির কারণে সামাজিক অসমতা বা স্তরবিন্যাস সৃষ্টি হয়। জৈবিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা সমাজস্থ মানুষের পদমর্যাদার গুরুত্ব তখনই নির্ণীত হয় যখন সামাজিকভাবে সমাজের সদস্যবৃন্দের বিচারে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার তাঁর মর্যাদায় আসীন হন তাঁর বিশেষ বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষা ও উপযুক্ততা যাচাইয়ের মাধ্যমে, শারীরিক শক্তি বা বয়সের মাধ্যমে নয়। তাঁর শিক্ষা, দক্ষতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব তাঁকে সমাজের বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। অতএব, সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে সমাজস্থ মানুষের মূল্যবোধ ক্রিয়াশীল। অর্থাৎ সমাজস্থ মানুষের মনোভাব, অনুমোদন বা মূল্যায়নই স্তরবিন্যাসের ভিত্তি। সেজন্য এর অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সামাজিক।
২) সামাজিক স্তরবিন্যাস সার্বজনীন
সামাজিক স্তরবিন্যাস একটি সার্বজনীন অবস্থা। মানব সভ্যতার এমন কোন যুগ পাওয়া যায় না যেখানে স্তরবিন্যাস নেই বা ছিল না। অর্থাৎ সর্বযুগে সর্বকালে সার্বজনীন সামাজিক কাঠামোরই স্বাভাবিক রূপ হচ্ছে সমাজের স্তরবিন্যাস। সমাজবিজ্ঞানী সরোকিন তাঁর “Social Mobility” নামক গ্রন্থে বলেছেন যে, সকল স্থায়ী সমাজেই মানুষের বিভিন্ন সামাজিক স্তর রয়েছে। সুদূর অতীতে সমাজ যেমন গড়ে উঠেছিল আত্মরক্ষার তাগিদে, পরস্পর সহযোগিতা, নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলা প্রভৃতির প্রয়োজনে, তেমনি সমাজের স্তরবিন্যাসের সৃষ্টি হয়েছিল সম্পদ, ক্ষমতা, পেশা, ব্যক্তিগত গুণাবলী প্রভৃতিকে আশ্রয় করে সংগঠনের ভিত্তিতে সমাজের বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের টিকে থাকার অভিপ্রায়ে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, প্রাচীন রোমান সমাজে রাজা, অভিজাত, দার্শনিক, বড় ব্যবসায়ী, বৃহৎ জমির মালিক, প্রজাগণ এবং সৈনিক পুরুষরা ছিল উচ্চ শ্রেণীভুক্ত। ছোট ব্যবসায়ী, কারিগর ও অল্প জমির মালিকরা ছিল মধ্য শ্রেণী, আর কৃষক ও দাসরা ছিল নিম্ন শ্রেণীর। ভারতবর্ষে বৈদিক যুগের শেষ ভাগে চার বর্ণের উৎপত্তি ও পেশাগত কার্যের ভিত্তিতে সমাজে স্তরবিন্যাসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মধ্যযুগে ইউরোপে সামন্তবাদী সমাজের রাজা, পুরোহিত এবং বৃৎৎ ভূস্বামী ছিল সমাজের সর্বোচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি। আধুনিককালে সম্পদ ও শিক্ষার ভিত্তিতে সমাজের শ্রেণী গড়ে উঠেছে।
৩) সামাজিক স্তরবিন্যাস সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে
সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি অন্তর্মুখী বা ব্যক্তির মনোভাব সম্বলিত দিক রয়েছে। বিশেষ ধরনের কিছু মিথস্ক্রিয়া কেবলমাত্র স্তরভূক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গের মিথস্ক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের হয়ে থাকে। বৈবাহিক সম্পর্ক, বৃত্তি নির্বাচন, বন্ধুত্ব স্থাপন প্রভৃতি সাধারণ সমস্তর ও মর্যাদার ব্যক্তিদরে মধ্যেই হয়ে থাকে। এ ধরনের মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক স্তরবিন্যাসের নিয়ন্ত্রণ অধিকতর কঠোর ও কার্যকরী। কিন্তু যানবাহন, সভাসমিতি, খেলার মাঠ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মিথস্ক্রিয়ার ব্যাপারে সামাজিক স্তরবিন্যাসের তেমন কোন প্রভাব দেখা যায় না।
৪) সামাজিক স্তরবিন্যাসের রূপ ও প্রকৃতি
যদিও সামাজিক অসমতা সর্ব সমাজের জন্য অবশ্যম্ভাবী তথাপিও এর রূপ প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের হয়ে থাকে। অর্থাৎ সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য সকল সমাজে এক রকম নয়। কারণ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী বা স্তরের উৎপত্তি ভিন্ন ভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের সামাজিক স্তরবিন্যাসের সাথে অনুন্নত দেশের সামাজিক স্তরবিন্যাসের যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আবার বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গের প্রতি যে মর্যাদা দেয়া হয় তা সকল সমাজে এক রকম নয়। বিভিন্ন কারণে মান মর্যাদার ক্ষেত্রে তারতম্যের সৃষ্টি হয়। এ সমস্ত কারণের মধ্যে সামাজিক জীবনের মননশীলতা, বাস্তবতা, ধর্মীয় কারণ, কুসংস্কার বা রাজনৈতিক কারণও নিহিত থাকতে পারে।
৫) সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধারণা আনুষঙ্গিক
সমাজবিজ্ঞানীগণের মতে স্তরবিন্যাসের ধারণা আরো আনুষঙ্গিক বিষয়ের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। এগুলো হলো-
প্রথমত, সামাজিক স্তরবিন্যাস মানুষের জীবনের সম্ভাবনা বা জীবনযাত্রার নানা প্রকার সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয়ত, এটি জীবনধারণের প্রণালী নির্ধারিত হয়। প্রথম ক্ষেত্রে এটি মানুষের জীবনধারণের সম্ভাবনা দৃঢ়তর বা দুর্বল কর। শিশু জন্মমৃত্যু হারের হ্রাসবৃদ্ধির কারণ হয় স্বাস্থ্য, সন্তানহীনতা, স্বামী-স্ত্রীর বিরূপ ও বিচ্ছেদ এদের উপরও বিভিন্ন সামাজিক স্তরের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। জীবনযাত্রা প্রণালীর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার মধ্যে আছে বাসস্থান, পল্লী বা আঞ্চলিক সুযোগ সুবিধা, শ্রান্তি বিনোদনের বঞ্চিত ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক উন্নতির পন্থা, যানবাহন এবং যোগাযোগের ব্যবস্থা ইত্যাদি।
অতএব, বলা যায় যে, সামাজিক স্তরবিন্যাসের সাথে সামাজিক মর্যাদা ও সামাজিক ভূমিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেজন্য ম্যাকাইভার এবং প্যাজ এর মতে, “সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো মর্যাদাভিত্তিক গোষ্ঠীসমূহের উর্ধ্বে বিন্যাস।”