Home » স্বাধীনতার রক্ষাকবচ গুলো কি কি? বিস্তারিত আলোচনা

স্বাধীনতার রক্ষাকবচ গুলো কি কি? বিস্তারিত আলোচনা

by Rezaul Karim
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ গুলো কি কি

স্বাধীনতার রক্ষাকবচ সমূহ

স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত ও সামাজিক অধিকার। সমাজে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও জীবনে পূর্ণতা অর্জনের জন্য স্বাধীনতা অপরিহার্য। সামগ্রিকভাবে স্বাধীনতাকে শ্রম ও কষ্টের বিনিময়ে অর্জন এবং সংরক্ষণ করতে হয়। স্বাধীনতা অর্জন যেমন দুরূহ প্রক্রিয়া, স্বাধীনতা সংরক্ষণ তেমনি কঠিন। কেননা, নানা কারণে জনগণের স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাস্কি বলেন, ‘সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা ছাড়া অধিকাংশ লোক স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে না।’ অর্থাৎ সংরক্ষণের মধ্যে স্বাধীনতার মুহূর্ত উপভোগ্য হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার রক্ষাকবচ গুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো:

১. আইন

আইন স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত ও সহায়ক শক্তি এবং প্রধান রক্ষাকবচ। আইনবিহীন সমাজে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। জন লক বলেন, ‘যেখানে আইন নেই; সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না’। আইনের নিয়ন্ত্রণ স্বাধীনতাকে পরিপূর্ণ করে। আইন স্বাধীনতার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। তবে শুধু আইনের উপস্থিতিই যথেষ্ট নয়। স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য আইনের শাসন অপরিহার্য।

আরও দেখুন:   মূল্যবোধ কি | মূল্যবোধ কাকে বলে | মূল্যবোধ বলতে কি বুঝায়

২. আইনের অনুশাসন

আইনের শাসন স্বাধীনতার রক্ষাকবচ । আইনের শাসন বলতে আইনের প্রাধান্যকে বোঝায়। আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান, দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত সকলেই দেশের সাধারণ আইন মেনে চলতে বাধ্য। অর্থাৎ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। বিনা অপরাধে কাউকে কারাগারে আটক রাখা যাবে না।

৩. সংবিধানে মৌলিক অধিকার সন্নিবেশ

নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো সংবিধানে সন্নিবেশিত থাকলে এগুলো সাংবিধানিক মর্যাদা লাভ করে। সরকার, ব্যক্তি বা ব্যক্তিগোষ্ঠী সেই অধিকারগুলো লঙ্ঘন বা হরণ করতে পারে না। মৌলিক অধিকারগুলো আদালত কর্তৃক কার্যকরযোগ্য। সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এসব মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন বা ভঙ্গ করলে জনগণ সাংবিধানিক উপায়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে পারে।

৪. গণতন্ত্র

গণতন্ত্র স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকায় তা জনস্বার্থে পরিচালিত হয়। এই শাসনব্যবস্থায় জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া জনগণ অধিকার সচেতন থাকার ফলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ স্বাধীনতা রক্ষার ‘অতন্দ্র প্রহরী’ হিসেবে কাজ করে।

৫. দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা

দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ তার কাজ-কর্মের জন্য আইন বিভাগের কাছে দায়ী থাকবে। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দল কার্যকর ভূমিকা পালন করে ও গঠনমূলক সমালোচনা করে। তাই সরকার জনগণের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে সাহস পায় না।

৬. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ

ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নাগরিক স্বাধীনতার উল্লেখযোগ্য রক্ষাকবচ। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ যদি স্ব স্ব দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকে, তবে কোনো বিভাগ স্বৈরাচারী হতে পারবে না। ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষিত হবে।

৭. ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ

ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ বলতে সরকারের শাসন ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত না করে তা বিভিন্ন পেশাগত গোষ্ঠী বা স্থানীয় সংস্থাগুলোর হাতে অর্পণ করাকে বোঝায়। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা অধিক পরিমাণে সংরক্ষিত হয়ে থাকে।

আরও দেখুন:   মূল্যবোধের শ্রেণীবিভাগ | মূল্যবোধ কত প্রকার

৮. স্বাধীন বিচার বিভাগ

বিচার বিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হলে আইন এবং শাসনবিভাগের প্রভাব মুক্ত থেকে বিচারকার্য সম্পাদন করতে পারে। বিচার বিভাগ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তির অধিকারের রক্ষক ও অবিভাবক হিসেবে কাজ করে।

৯. শিক্ষার প্রসার

স্বাধীনতা রক্ষা করতে শিক্ষিত জনগণ প্রয়োজন। কেননা শিক্ষিত নাগরিকগণ নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়। ফলে সরকার ইচ্ছা করলেই নাগরিক অধিকার খর্ব করতে পারে না।

১০. সরকার ও জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক

স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে হলে সরকার ও জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা আবশ্যক। সরকার ও জনগণের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় থাকলে, সরকার জনস্বার্থ বিরোধী কোনো কাজ করতে পারে না। সরকার যদি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবি-দাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং জনগণ যদি সরকারের প্রতি আনুগত্যশীল হয়, তাহলে স্বাধীনতা রক্ষা করা সহজ হয়।

১১. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম জনমত গঠনে সহায়তা করে। এ কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একান্ত প্রয়োজন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ, আলোচনা, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের স্বাধীনতা হরণকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দূরভিসন্ধিমূলক কার্যক্রমকে তুলে ধরা হয়।

১২. সদা সতর্ক জনমত

স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হলো নাগরিকদের সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি এবং সদা সতর্ক জনমত। নাগরিকগণ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সচেতন না হলে এবং যে কোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত না থাকলে স্বাধীনতা রক্ষা অসম্ভব। গ্রিক দার্শনিক পেরিক্লিসের মতে, ‘চিরন্তন সতর্কতা স্বাধীনতার মূল্য এবং সাহসিকতা স্বাধীনতার মূলমন্ত্র।’ (Eternal vigilance is the price of liberty and the secret of liberty is courage.) লাস্কি বলেন, ‘চিরন্তন সতর্কতার মধ্যেই স্বাধীনতার মূল নিহিত।’

১৩. সৎ ও সুনির্দিষ্ট নেতৃত্ব

দেশে সৎ ও সুনিপুণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, সাহসী ও দৃঢ়চেতা নেতার উপস্থিতি জনগণের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।

পরিশেষে বলা যায় যে, খণ্ডিতভাবে স্বাধীনতার উপলব্ধি অসম্ভব। সমাজের কোনো একটি অংশের স্বাধীনতার অসংগতির ভিত্তিতে যথার্থ স্বাধীনতার পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে না। সর্বোপরি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জনগণ সচেতন, সতর্ক ও সচেষ্ট না হলে নিছক আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির মাধ্যমে স্বাধীনতা সংরক্ষণ সম্ভব নয়।

অতএব আপনারা স্বাধীনতার রক্ষাকবচ গুলো সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করলেন। এগুলোই হলো স্বাধীনতা রক্ষার মূল হাতিয়ার। আমাদের সবাইকে স্বাধীনতা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা অনেক বেশি কঠিন।

Related Posts

1 comment

Comments are closed.