ইসলামি অর্থব্যবস্থা
ইসলামের মৌলিক নিয়মকানুনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ইসলামি অর্থব্যবস্থা বলা হয়। ইসলামি অর্থব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট্য সমাজ ও ব্যক্তির প্রকৃত কল্যাণের মধ্যে নিহিত। ইসলামি অর্থব্যবস্থার লক্ষ্য কল্যাণ ও অকল্যাণের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় এবং ব্যক্তি ও সমাজজীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
সুরা বাকারায় বলা হয়েছে, “যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আল্লাহ তায়ালার দেওয়া বিধান অনুযায়ী মানুষের জীবিকা অর্জন ও যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্য সম্পাদিত হয়, তাকে ইসলামি অর্থব্যবস্থা বলে।”
তুরস্কের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. সাবাহ ইলদীন জাইম বলেন, “ইসলামি অর্থনীতি বলতে ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা ও তার আচরণের সুসংবদ্ধ বিশ্লেষণ ও অধ্যয়নকে বোঝায়।”
মিশ্র অর্থব্যবস্থা কি বা কাকে বলে? মিশ্র অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি? |
ইসলামি চিন্তাবিদ ড. এম. এ. মান্নান বলেন, “ইসলামি অর্থনীতি হলো একটি সামাজিক বিজ্ঞান, যা ইসলামের আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাবলি আলোচনা করে।” (Islamic economics is a social science which studies economic problems of the people in the light of Islam.)
ইসলামি অর্থব্যবস্থার উৎস
ইসলামি অর্থনীতির জ্ঞানের মূল উৎস হলো চারটি। যথা-
ক. পবিত্র কুরআন,
খ. সুন্নাহ বা হাদিস (মহানবি (স.)-এর ২৩ বছর জীবনের কথা, কর্ম, অনুমোদন, সম্মতি, অসম্মতি),
গ. ইজমা বা ঐকমত্য (এটি ইসলামি আইনের ৩য় উৎস। কোনো বিতর্কিত বিষয়ে মুজতাহিদগণ যদি ঐকমত্য হন, তখনই একে ইজমা বলা হয়।) ও
ঘ. কিয়াস (নতুন সমস্যায় পুরাতন সমস্যার সমাধান প্রয়োগ করাকে কিয়াস বলে।)
ইসলামি অর্থনীতির মূলনীতি
ইসলামি অর্থনীতি যেসব মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত তা হলো-
১. সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর, মানুষ তার প্রতিনিধি হিসেবে সম্পদের আমানতদার।
২. সম্পদ উপার্জন, উৎপাদন ও ভোগে হালাল ও হারামের পার্থক্যকরণ।
৩. যাকাত, উশর, জিজিয়া ও সাদকায়ে ফিতর ইত্যাদি ব্যবস্থার প্রবর্তন।
৪. উত্তরাধিকার আইন বাস্তবায়ন।
৫. সুদ, ঘুষ, শোষণ, মজুতদারি, জুলুম প্রভৃতি রহিতকরণ।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা কাকে বলে | সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য |
ইসলামি অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ
অন্যান্য অর্থব্যবস্থার মতো ইসলামি অর্থব্যবস্থারও কতিপয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। ইসলামি অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ-
১. বৈষয়িক উন্নতির সাথে নৈতিক উন্নতির সমন্বয় সাধন: ইসলামি অর্থব্যবস্থায় মানুষের বৈষয়িক উন্নতির সাথে তার নৈতিক উন্নতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ নৈতিক উন্নতি ছাড়া বৈষয়িক উন্নতি সমাজে দুর্নীতি ও পরিণামে অনুন্নতি সৃষ্টি করতে পারে।
২. অধিকার ও দায়িত্ব: ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সমাজের ব্যক্তি ও সমষ্টির অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্যে কোনো বিরোধ বা বৈষম্য নেই। এ ব্যবস্থায় পরিপূর্ণ সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়। প্রত্যেক ব্যক্তিকে মর্যাদা ও জীবনধারণের অধিকারের সাথে সাথে তার সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
৩. শ্রমের মর্যাদা: ইসলামি অর্থব্যবস্থায় শ্রমের উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ইসলামি সমাজে শ্রম ছাড়া কোনো অর্থনৈতিক অধিকার স্বীকৃত নয়। এ সমাজে নারীকেও শ্রমের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহের অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থায় আন্তরিকতার সাথে কাজকে সেরা উপার্জন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
৪. অপচয় ও বিলাস: ইসলামি অর্থব্যবস্থায় শরিয়াহ বিধিবিধান দ্বারা ভোগকর্ম নিয়ন্ত্রিত। সেজন্য এখানে অপচয় ও বিলাসকে সমর্থন করা হয় না। প্রয়োজনের বেশি ব্যয় সমর্থিত নয়। অর্জিত আয় উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় বণ্টন হতে হবে। অর্জিত উদ্বৃত্ত আয় আর্থসামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে হবে।
৫. সম্পদের মালিকানা: ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সম্পদ ও সম্পত্তিতে মানুষের নিরঙ্কুশ মালিকানা স্বীকৃত নয়। সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে স্রষ্টার আমানতদার হিসেবে গণ্য করে। সেজন্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাফল্য মানুষের চরিত্রে দুর্নীতি ও লোভ সৃষ্টি করতে পারে না।
৬. মানবকল্যাণ: ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সম্পদের কল্যাণমূলক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সেজন্য দেশের সকল প্রাকৃতিক ও মানবীয় সম্পদকে মানুষের আয়ত্তাধীন এবং তার কল্যাণে ব্যবহারের কথা বলা হয়।
৭. শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত: ইসলামি অর্থব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এ অর্থনীতি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত হয়। এ অর্থব্যবস্থা মানব রচিত অর্থব্যবস্থা নয়। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ হলো ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূল উৎস।
৮. সুদমুক্ত অর্থনীতি: ইসলামি অর্থব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ‘রিবা’। সাধারণত ‘রিবা’ বলতে সুদ বোঝায়। ব্যাপক অর্থে, পরিশ্রম না করে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করার নাম হলো ‘রিবা’। মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সুদ নামক অর্থ লাভ করাকে ইসলামি অর্থব্যবস্থায় হারাম করা হয়েছে।
৯. বায়তুল মাল: ইসলামি অর্থব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘বায়তুল মাল’। ‘বায়তুল মাল’ অর্থ হলো সরকারি অর্থ তহবিল গঠন। এ অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আয়ের একটি অংশ ‘বায়তুল মাল’-এ জমা রাখা হয়। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সরাসরি এ তহবিল থেকে প্রয়োজনে অর্থের যোগান দেওয়া হয়।
১০. জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি: ইসলামি অর্থব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি। ইসলামি বিধান অনুযায়ী কারও কাছে অধিক অর্থসম্পদ এক বছর জমা থাকলে নির্দিষ্ট হারে তাকে জাকাত প্রদান করতে হয়। বিত্তশালী ব্যক্তিদের জন্য জাকাত ফরজ এবং অসহায় ব্যক্তিদের জাকাতের অর্থ প্রাপ্তি অধিকার।