একক পরিবার ও যৌথ পরিবারের মধ্যে পার্থক্য
আধুনিক যুগে সমাজবিজ্ঞানীগণ পরিবারকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। কারণ কোন পরিবার যখন সমাজে একটি সংগঠন হিসেবে বিরাজমান তখন সেই পরিবারকে যৌথভাবে অন্যান্য পরিবারের (অবশ্য একই রক্ত সম্পৰ্কীয়) সাথে একত্রে বসবাস করতে দেখা যায়। আবার শুধু স্বামী–স্ত্রী ও তাদের সন্তান সন্ততিসহ বাস করতে দেখা যায়। এ পর্যায়ে সংখ্যা ও সদস্য অনুযায়ী পরিবারের প্রকারভেদ লক্ষ করা যায়; যেমন– একক পরিবার (Nuclear family) ও যৌথ পরিবার ( Joint family)।
ক. একক পরিবার (Nuclear family)
একক পরিবার বলতে আমরা বুঝে থাকি যখন একজন পুরুষ তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পৃথকভাবে বসবাস করে। একক পরিবার স্ত্রী ও সন্তান সন্ততি সমবায়ে গঠিত হয়ে থাকে। একক পরিবার চিরন্তন সামাজিক দৃষ্টির বিষয়ীভূত সংগঠন।
মূলত আমরা দেখতে পাই যে, এই একক পরিবার থেকেই সকল প্রকার পরিবারের উদ্ভব হয়েছে এবং যে কোন পরিবার স্ত্রী ও পুরুষকে নিয়ে গঠিত হয়। আধুনিক যুগে একক পরিবারের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকের মতে এর কারণ হচ্ছে আধুনিক ব্যক্তিবাদ বা Individualism এর ক্রিয়াশীলতা।
এছাড়াও আধুনিক শিল্পোন্নত দেশগুলোতে একক পরিবারের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে চলেছে। এর উৎপত্তির আরো একটি কারণ হচ্ছে পরিবারের দায়িত্ব ক্রমবর্ধমানভাবে রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত হচ্ছে। ব্যক্তি পূর্বের ন্যায় আর পরিবারের উপর ও পরিবারের সদস্যের উপর নির্ভরশীল নয়। পরিবারের অনেক দায়িত্বই রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মারফত সমাধা হয়ে থাকে। পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন একক পরিবার সার্থকভাবে পাশ্চাত্য দেশে গড়ে উঠেছে। আধুনিক স্বাধীন একক পরিবারের সংহতি মূলত যৌন আকর্ষণ ও স্বামী–স্ত্রীর সাহচর্যের এবং তাদের সন্তান–সন্ততিদের সাহচর্যের উপর নির্ভরশীল।
বিশ্বের যে দেশগুলোতে শিল্প এবং যান্ত্রিকতার প্রসার ঘটেছে সেসব দেশে সহজাতভাবেই একক পরিবার গড়ে উঠেছে। কারণ শিল্প–কারখানায় কাজ করায় শ্রমিকগণ ঘরছাড়া হতে বাধ্য হয়েছে। কোন কোন শ্রমিককে গ্রাম ছেড়ে নগরে কাজে আত্মনিয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে। এর ফলে যৌথ পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্রভাবে নিজের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে আলাদা পরিবার গঠন করতে হচ্ছে। আমাদের দেশেও বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মৌলিক কারণ হচ্ছে শিল্পায়ন, নতুন নতুন নগর, শহর ও বন্দরের পত্তন এবং শিক্ষার প্রসারতার সাথে সাথে চাকরিজীবীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ।
খ. যৌথ পরিবার (Joint family)
যে পরিবার বৃদ্ধ পিতামাতা, ভাইবোন, স্ত্রী ও সন্তান–সন্ততিসহ একত্রে বসবাস করে তাকে যৌথ পরিবার বলে। একক পরিবারের মতো কেবল স্বামী–স্ত্রী এবং তাদের সন্তান–সন্তুতিই যৌথ পরিবারের সদস্য নয়– যৌথ পরিবারের ব্যাপ্তি আরো ব্যাপক। যৌথ পরিবারের ধর্ম ও সম্পত্তি এক। যৌথ পরিবারের বন্ধন দৃঢ় হওয়ার পিছনে পরিবারের কর্তার বা পিতার বিষয়–সম্পত্তি একটি প্রধান বিষয়। যৌথ পরিবার অনুন্নত সমাজের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক লোককে যৌথ পরিবারে ক্ষমতা অনুযায়ী গ্রহণ এবং প্রত্যেক লোককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী প্রদান– এ নীতির ভিত্তিতে যৌথ পরিবার পরিচালিত হয়।
বিশেষকরে, কৃষিভিত্তিক প্রসারতা, নগরের পতন ও ব্যক্তিস্বার্থ প্রসারের সাথে সাথে যৌথ পরিবারে ভাঙন শুরু হয়েছে। এছাড়াও কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ও শিক্ষা প্রসারের ফলে যৌথ পরিবারের প্রয়োজনীয়তা লোপ পাচ্ছে।
যৌথ পরিবার অনুন্নত দেশ ও কৃষিভিত্তিক সমাজে বিশেষ ফলপ্রসূ হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক যুগে যান্ত্রিক ও শিল্পোন্নত হওয়ার ফলে পারিবারিক যৌগ ব্যবস্থা টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আর সে কারণেই উন্নতশীল ও উন্নয়নকামী দেশগুলোতে বিশেষকরে শিল্পোন্নত সমাজে এর ভাঙন দেখা যাচ্ছে এবং একক পরিবারের প্রাধান্য বেড়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: পরিবারের কার্যাবলী আলোচনা