কাম্য জনসংখ্যা
কাম্য জনসংখ্যা এমন একটি জনসংখ্যার স্তর নির্দেশ করে যেখানে উৎপাদন এবং আয় সর্বাধিক হয়। অর্থাৎ যে জনসংখ্যায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব তাকে কাম্য জনসংখ্যা বলে।
কাম্য জনসংখ্যার কথা প্লেটো এবং বটেরো কয়েকশ বছর পূর্বে বললেও বর্তমান শতাব্দীতে জুলিয়াস উলফ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাম্য জনসংখ্যার বিশ্লেষণ করেন। কোনো স্থানের জনসংখ্যা কম (Under population) বা বেশি (Over population) হতে পারে। কাম্যজনসংখ্যা হলো কম অথবা বেশি জনসংখ্যার ত্রুটিমুক্ত মাঝারি একটি অবস্থা।
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব চিত্রসহ ব্যাখ্যা কর |
K. E. Boulding-এর মতে, যে জনসংখ্যার দ্বারা জীবনযাত্রার মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে, তাকে কাম্যজনসংখ্যা বলে।
অধ্যাপক ডালটনের মতে, কাম্যজনসংখ্যা হলো তা, যা মাথাপিছু আয়কে সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত করে।
কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বের সূত্র
অধ্যাপক ড. ডালটন কাম্যজনসংখ্যা পরিমাপের জন্য নিম্নে উল্লিখিত সূত্রটি প্রদান করেন:
M = A – O/O
এক্ষেত্রে, M = অসামঞ্জস্যের পরিমাণ (Maladjustment)
A = প্রকৃত জনসংখ্যা (Actual Population)
O = কাম্য জনসংখ্যা (Optimum Population)
M এর মান ধনাত্মক (+ve) হলে অধিক জনসংখ্যা, ঋণাত্মক (-ve) হলে নিম্ন জনসংখ্যা এবং শূন্য (০) হলে কাম্যজনসংখ্যা নির্দেশ করে।
কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্ব
উৎপত্তি: কাম্য জনসংখ্যা সম্পর্কে অধ্যাপক Edward West এবং Henry Sidgwickসহ অনেক অর্থনীতিবিদ ধারণা প্রদান করলেও ‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস্’-এর অধ্যাপক এডউইন ক্যানন (Prof. Edwin Cannan) কর্তৃক ১৯২৪ সালে প্রকাশিত “Wealth” নামক গ্রন্থে কাম্যজনসংখ্যা ধারণা তত্ত্বাকারে উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে এ ধারণা রবিনসন্স (Robinsons), ডাল্টন (Dalton) এবং কার সানডারস (Carr Saunders) কর্তৃক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯২৩ সালে “The Population Problem: A study in Evolution.” গ্রন্থে Carr Saunders-এর বক্তব্যটি অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে বিধায় কাম্যজনসংখ্যা তত্ত্ব বলতে কার সানডারস-এর তত্ত্বকে বোঝায়।
মূলকথা: কাম্য জনসংখ্যা বলতে মাথাপিছু সর্বোচ্চ আয় স্তরের জনসংখ্যাকে বোঝায়। অর্থাৎ কাম্যজনসংখ্যা বলতে জনসংখ্যার এমন একটি স্তর বোঝায়, যেখানে নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থা সাপেক্ষে সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয় অর্জিত হয়। দেশের প্রকৃত জনসংখ্যা যদি কাম্যজনসংখ্যা অপেক্ষা কম বা বেশি হয় তাহলে উৎপাদনের পরিমাণ ও মাথাপিছু আয় সর্বাধিক অপেক্ষা কম হবে। এ তত্ত্ব অনুসারে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জনসংখ্যা থাকা প্রয়োজন। এ নির্দিষ্ট পরিমাণ জনসংখ্যাকেই কাম্যজনসংখ্যা বলা হয়।
অনুমিত শর্তসমূহ:
(১) জনসংখ্যা বৃদ্ধির সময়, মোট জনসংখ্যা ও কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাত স্থির।
(২) কর্মক্ষম জনসংখ্যার মাথাপিছু উৎপাদন ঘণ্টা স্থির।
(৩) নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশে-
(i) প্রাকৃতিক সম্পদ স্থির,
(ii) কারিগরি কৌশল স্থির ও
(iii) মূলধনের পরিমাণ স্থির।
(৪) দেশে পূর্ণ নিয়োগ অবস্থা বর্তমান।
(৫) উন্নত জ্ঞান, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা এবং
(৬) পর্যাপ্ত জনশক্তির কর্মোদ্যম।
কাম্য জনসংখ্যা সম্পর্কে অভিমত: অধ্যাপক রবিনসনের মতে, যেখানে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উৎপন্ন বা প্রতিদান সৃষ্টি হয়, সে স্তরের জনসংখ্যাকে কাম্যজনসংখ্যা বলা হয়। অধ্যাপক হিকস্-এর মতে, কাম্যজনসংখ্যা ঐ স্তরকে নির্দেশ করে, যেখানে মাথাপিছু উৎপাদন সর্বোচ্চ হয়। Carr-Saunders বলেন, যে জনসংখ্যার স্তরে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক কল্যাণ পাওয়া যায়, সে স্তরের জনসংখ্যাকে কাম্যজনসংখ্যা বলা হয়।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলফ্রেড সারভে (Alfred Servey) তাঁর ‘The General Theory of Population’ গ্রন্থে কাম্যজনসংখ্যা সম্পর্কে বলেন, যে স্তরে মাথাপিছু প্রান্তিক উৎপাদন সর্বোচ্চ সে স্তরের জনসংখ্যাকে কাম্য জনসংখ্যা বলা হয়।
অতএব, উপরিউক্ত অভিমত পর্যালোচনা করে বলা যায়, যে স্তরে সর্বোচ্চ মাথাপিছু উৎপাদন, সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক কল্যাণ, সর্বোচ্চ উৎপাদন ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হয়, সে স্তরের জনসংখ্যাকে কোনো দেশের কাম্যজনসংখ্যা বলা হয়।
তত্ত্বের বিশ্লেষণ: মনে করি, বাংলাদেশে কাম্য জনসংখ্যা হলো ৪ কোটি এবং বর্তমান জনসংখ্যা হলো ১৪ কোটি। এক্ষেত্রে কাম্যজনসংখ্যা নির্ণয়ের ডালটন-এর সূত্রের সাহায্যে পাই,
M = A -O/O
এখানে, M = অসামঞ্জস্যের পরিমাণ, O = কাম্যজনসংখ্যা এবং A = প্রকৃত জনসংখ্যা
∴ M = ১৪ – ৪/৪ = ১০/৪ ২.৫
আমরা জানি, M এর মান যত বড় হবে জনসংখ্যার অসামঞ্জস্য তত বেশি হবে বলা যায়। এ মান ধনাত্মক হলে অধিক জনসংখ্যা এবং ঋণাত্মক হলে নিম্ন জনসংখ্যা এবং শূন্য হলে কাম্য জনসংখ্যা নির্দেশ করে।
K. E. Boulding-এর কাম্যজনসংখ্যার ধারণাকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Alfred Survey তাঁর “The General Theory of Population’ গ্রন্থে নিম্নের প্রায় অনুরূপ চিত্রের দ্বারা প্রকাশ করেন:
চিত্র বিশ্লেষণ: চিত্রে ভূমি অক্ষে জনসংখ্যা ও লম্ব অক্ষে জীবনযাত্রার মান নির্দেশ করা হয়। SS রেখা হলো জীবনযাত্রার রেখা যাকে বলা হয় জনসংখ্যার একটি অপেক্ষক (Standard of living is the function of population) অর্থাৎ S = ƒ(P),
এক্ষেত্রে dS/dP = ƒ'(P) = 0 হলো কাম্য জনসংখ্যা স্তর, ƒ'(P) > 0 হলে জনসংখ্যা কাম্যস্তর অপেক্ষা কম এবং ƒ'(P) <0 হলে জনসংখ্যা কাম্যস্তর অপেক্ষা অধিক হয়।
চিত্র থেকে লক্ষ করা যায়, ON জনসংখ্যা স্তরে M বিন্দুতে জীবনযাত্রার মান সর্বোচ্চ। এরূপ জনসংখ্যাকেই Boulding কাম্যজনসংখ্যা বলেন। চিত্রে, OPu হলো নিম্ন জনসংখ্যা (Under population) এবং OPo হলো অধিক জনসংখ্যা (Over population)। এরূপ ক্ষেত্রে দেশে প্রাপ্ত সম্পদের তুলনায় প্রকৃত জনসংখ্যা যথাক্রমে কম ও বেশি হওয়ায়, সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার ও দুষ্প্রাপ্যতার কারণে জীবনযাত্রার মান কম হয়।
কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বের সমালোচনা
কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বের ব্যবহারিক উপযোগিতা এবং তত্ত্বের মূল্যমান না থাকায় এটি অধিকতর দুর্বল হয়ে পড়ছে।
নিম্নে এ তত্ত্বের ত্রুটিসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. অবাস্তব তত্ত্ব: কাম্যজনসংখ্যা তত্ত্ব জনসংখ্যা বিষয়ক বাস্তব তত্ত্ব নয়। কারণ এ কাম্য জনসংখ্যা স্তর কোথায় তা বলা কঠিন এবং পরিমাপ করাও কঠিন।
২. মাথাপিছু আয় সঠিকভাবে নির্ণয়ে অকার্যকর: মাথাপিছু আয় নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সকল তথ্যই প্রায় অপর্যাপ্ত, ভুল এবং অবিশ্বাসযোগ্য যা কাম্য জনসংখ্যাকে সন্দেহজনক করে তোলে।
৩. বর্ধিত মাথাপিছু আয় বণ্টনে এ তত্ত্ব অসমর্থ: বর্ধিত জনসংখ্যার বর্ধিত আয় বণ্টনে এ তত্ত্ব অসমর্থ।
৪. কাম্য জনসংখ্যার চলমান বিন্দু: মানুষের জ্ঞান সাধনার মাধ্যমে ক্রমাগত আবিষ্কার ও গবেষণার ফলে সম্পদের পরিমাণগত এবং গুণগত পরিবর্তনের দ্বারা জীবনযাত্রার মানেরও পরিবর্তন ঘটছে। এ অবস্থায় কাম্যস্তরও পরিবর্তন হয়। অধ্যাপক ক্লার্ক মনে করেন জনসংখ্যা বিষয়ক কাম্যতার স্তর স্থির বিন্দু নয়। বিষয়টি নিচের চিত্রে দেখানো হলো-
চিত্রে ক্রমাগত আবিষ্কার ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন সম্পদ প্রাপ্তির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন হয়। মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পায়। এর ফলে কাম্যজনসংখ্যা স্তর ON থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ON’ হয় এবং কাম্য জীবনযাত্রার মানেরও পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ কাম্যতার স্তর স্থির ধারণা নয় (Optimum level is not a static concept).
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব সমালোচনা সহকারে আলোচনা কর |
৫. তত্ত্বটি অব্যবহারিক ও অবৈজ্ঞানিক: অধ্যাপক বি. কে. সরকার (B. K Sarker)-এর মতে, এ তত্ত্বটি অবৈজ্ঞানিক, তাই গুরুত্ব নেই এবং হিকস্ কর্তৃক সমর্থিত যে, কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বের কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই। অর্থনীতিবিদ মিরডাল (Myrdal)-এর মতে, “কাম্যজনসংখ্যা তত্ত্বটি বর্তমান জগতের সাথে সম্পর্কবিহীন একটি কল্পনাপ্রসূত ধারণা মাত্র।” (“The optimum theory is a speculative figment of the mind without any real connection with the world.”)
৬. কাম্যতা ধারণা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত: ম্যানুয়েল গট্ লিব (Manuel Gott Lieb)-এর মতে, “বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে কাম্যতাকে ব্যবহার করেন। যেমন- অর্থনৈতিক কল্যাণ, জীবনযাত্রার মান, প্রকৃত আয় ইত্যাদি।” এর ফলে কাম্যতার কাম্য ধারণা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
কাম্য জনসংখ্যার তত্ত্ব সম্পর্কে উপরিউক্ত বিভিন্ন সমালোচনা থাকায়, অনেক অর্থনীতিবিদ একে কোনো তত্ত্ব বলে স্বীকার করে না। তবে জনসংখ্যা ও মাথাপিছু সর্বোচ্চ আয়-এ দুটি উপাদান দ্বারা কাম্যতা তথা সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয় নির্দেশক জনসংখ্যা ধারণা অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া, ম্যালথাসের তত্ত্ব নিরাশাবাদী, ভীতিকর, নিরানন্দময় ও অবাস্তব। সে তুলনায় কাম্যজনসংখ্যা তত্ত্বের বিশ্লেষণের পটভূমি অধিকতর বাস্তব, বিস্তৃত ও যুক্তিনিষ্ঠ। এছাড়া জীবনযাত্রার মানের গতি নির্ধারণেও কাম্য জনসংখ্যার যথেষ্ট ভূমিকা বিদ্যমান। তাই ম্যালথাসের তত্ত্ব অপেক্ষা কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বের আওতা, পরিধি অনেক প্রসারিত।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাম্য কি-না?
‘কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্ব’ দেশে প্রাপ্ত মোট সম্পদের প্রেক্ষিতে আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশে এখনও অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে প্রাপ্ত এদেশের সকল প্রাকৃতিক সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার এখনও হয়নি এবং মাথাপিছু আয়ও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাম্যস্তর অতিক্রম করেছে কি-না তা বলা সম্ভব না হলেও বর্তমানে চরম দরিদ্রতা, তীব্র বেকার সমস্যা, পুষ্টিহীনতা, সামাজিক অবক্ষয়সহ জীবনযাত্রার নিম্নমানের যে ভয়াবহ চিত্র বিরাজ করছে, তাতে বাংলাদেশকে অধিক জনসংখ্যার দেশ হিসেবে স্বীকার করাই বাস্তবসম্মত। বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে কাম্য আকারে উপস্থাপনের জন্য দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাসের মাধ্যমে, মাথাপিছু সম্পদ বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন সাধন আবশ্যক।