কৃষি ঋণ
বাংলাদেশের কৃষি ভরণপোষণ পর্যায়ে (Subsistence level) পরিচালিত হচ্ছে বিধায় উপকরণ হিসেবে কৃষি ঋণ একটি বা ডিন্ন মাত্রার গুরুত্ব বহন করে। কৃষি কাজের ব্যয় নির্বাহের জন্য কৃষকরা যে ঋণ গ্রহণ করে, তাকে কৃষি ঋণ বলে। জমি এ থাকলেই উৎপাদন করা যায় না। উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন উপকরণ লাঙল, গরু, যন্ত্রপাতি, বীজ, সার, কীটনাশক ওষুধের প্রয়োজন হয়। কিন্তু কৃষকরা গরিব বলে মূলধনের অভাবে এসব উপকরণ ক্রয় করতে পারে না। অতএব, কৃষির আনুষাঙ্গিক উপকরণ ক্রয় এবং অন্যান্য উৎপাদন ব্যয় নির্বাহের জন্য কৃষকেরা যে ঋণ গ্রহণ করে, তাকে Agricultural Credit বা কৃষি ঋণ বলা হয়।
কৃষকরা কেন ঋণ গ্রহণ করে
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দরিদ্র দেশ। এদেশের কৃষকগণ উপকরণ ক্রয়, কৃষি জমির রক্ষণাবেক্ষণ, উৎপাদিত ফসলের বাজারজাতকরণ ইত্যাদি কারণে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সেজন্য কৃষি ঋণকে কৃষকের প্রয়োজন ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
১. উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে কৃষিঋণ
উদ্দেশ্যের দিক থেকে কৃষিঋণকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা:-
(i) উৎপাদনশীল ঋণ: যে ঋণ প্রত্যক্ষভাবে কৃষি উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে, তাকেই উৎপাদনশীল ঋণ বলে। যেমন- বীজ, সার, ওষুধ, গরু, সেচব্যবস্থা, মজুরি দেয়া, জমির স্থায়ী উন্নয়ন ইত্যাদি সবই উৎপাদনশীল ঋণ। কৃষি উৎপাদনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখার জন্য এ ধরনের ঋণের প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে এ ধরনের ঋণ পাওয়া যায়।
কৃষি পণ্যের বিপণন কি? বাংলাদেশে কৃষি পণ্যের বিপণন সমস্যা |
(ii) ভোগ্য ঋণ: প্রান্তিক কৃষক ও ভূমিহীন কৃষকদের এক ঋতুর ফসলে বছরের ভরণপোষণ সংগ্রহ সম্ভব হয় না। এছাড়া বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি কারণে ফসলহানি ঘটে। এ সময় কৃষকদের দৈনন্দিন প্রয়োজন তথা বেঁচে থাকার জন্য ভোগ্যঋণ গ্রহণের প্রয়োজন হয়। এ ধরনের অনুৎপাদনশীল ঋণ গ্রাম্য মহাজন, সাহুকার, ভূ-স্বামীর নিকট থেকে উচ্চ সুদের হারে সংগ্রহ করতে হয়।
(iii) অনুৎপাদনশীল ঋণ: ভোগ ছাড়াও কৃষককে নানা ধরনের অনুৎপাদনশীল কর্ম যেমন মামলা মোকদ্দমা, সন্তানদের বিয়েশাদী, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, জন্ম-মৃত্যু প্রভৃতি কাজে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। যেহেতু এসব খাত অনুৎপাদনশীল তাই এ ঋণও মহাজন ও ভূস্বামীর নিকট থেকে গ্রহণ করতে হয়।
২. সময়ের ভিত্তিতে কৃষিঋণ
এক্ষেত্রে কৃষিঋণ তিন ধরনের হতে পারে। যথা:-
(i) স্বল্পকালীন ঋণ: স্বল্প সময়ের জন্য সাধারণত ১৫ মাস বা তার কম সময়ের জন্য এ ধরনের ঋণ নেয়া হয়। বীজ, সার, কীটনাশক ওষুধ, গরু-মহিষের জন্য খামার ইত্যাদি ক্রয় করার জন্য কৃষকেরা এ ধরনের ঋণ প্রাতিষ্ঠানিক’ ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে সংগ্রহ করে।
(ii) মধ্যকালীন ঋণ: এ ধরনের ঋণ গরু-মহিষ কেনা, ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি ক্রয়, যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে মেরামত ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়। এ ধরনের ঋণের মেয়াদ ১৫ মাস থেকে ৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে। এ ঋণের উৎস হলো মহাজন, আত্মীয় স্বজন, সমবায় সমিতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক ব্যবস্থা।
(iii) দীর্ঘকালীন ঋণ: কৃষি ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য এ ঋণের প্রয়োজন হয়। যেমন-জমির স্থায়ী উন্নয়ন, নলকূপ বসানো, ট্রাক্টর ক্রয়, ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয়, পুরানো ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ ঋণের প্রয়োজন। এর মেয়াদকাল ৫ বছরের বেশি হয়ে থাকে। প্রয়োজন অনুসারে বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক থেকে কৃষকেরা এ ঋণ গ্রহণ করে থাকে।
৩. জামিনের ভিত্তিতে কৃষিঋণ
এ দিক থেকেও কৃষিঋণকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
(i) জমি বন্ধকি ঋণ: অনেক সময় কৃষকেরা নিজেদের ক্ষুদ্র জমি বন্ধক রেখে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করে।
(ii) ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত করার জন্য অস্থাবর সম্পত্তির অতিরিক্ত ঋণ: পূর্বের ঋণ পরিশোধ করার জন্য অনেক সময় কৃষক অস্থাবর সম্পত্তির অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করে। এ ধরনের ঋণ পরিশোধে কৃষকদের শ্রমের গুরুত্বই অধিক।
(iii) ব্যক্তিগত ঋণ: কৃষক ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজনেও সম্পদ বন্ধক রেখে ঋণ গ্রহণ করে।
৪. ব্যক্তিগত এজেন্সির ঋণ
কৃষিঋণের এ ধরনের ঋণ ব্যক্তিগত এজেন্সি প্রদান করে থাকে। সাধারণত ঋণ ব্যবসায়ী, ভূস্বামী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন প্রভৃতির কাছ থেকে কৃষকেরা এ ঋণ সংগ্রহ করে। এসব ঋণ বেশির ভাগই শোষণমূলক।
আদর্শ খামার কাকে বলে? আদর্শ খামারের নির্ধারক সমূহ কি কি? |
৫. প্রাকৃতিক দুর্যোগ
প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর ফলে প্রায় কৃষক পরিবারের জান-মালের প্রচুর ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। তখন অভাবের সম্মুখীন হয়ে তারা ঋণ গ্রহণ করে।
৬. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
কৃষকদের আয়ের তুলনায় যদি বাজারে দ্রব্যমূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়, তখন সংসার চালানোর জন্য বাধ্য হয়ে ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, দরিদ্র কৃষক কৃষির উন্নয়ন, পারিবারিক ও সামাজিক প্রয়োজনে কৃষিঋণ গ্রহণ করে। অর্থনীতিবিদ স্যার ফ্রেডারিক নিকলসন-এর মতে, ‘পৃথিবীর ইতিহাসের এই সাক্ষ্য যে, কৃষির জন্য ঋণ অত্যাবশ্যক’।