গোষ্ঠী কাকে বলে?
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজকে যেমন মানুষ গড়ে, আবার তেমনি সমাজের মাঝে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করারও চেষ্টা করে। কেউ এ চেষ্টা এককভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। তাই সর্বযুগে সর্বত্র মানুষকে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে হয়। নিঃসঙ্গ একাকিত্বের জীবন মরু জীবন। একাকিত্বের যন্ত্রণা ঘোচানোর জন্য সমাজে প্রয়োজন হয় সাথীর। দেখা গেছে পূর্বকালে সামাজিক অন্যায়ের জন্য অপরাধীকে দ্বীপান্তর দেয়া হতো। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ কখনো একা থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। সেজন্যই মানুষকে সামাজিক জীব বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে হলে প্রয়োজন হয় দলগত জীবন বা গোষ্ঠী জীবন। দল বা গোষ্ঠী বলতে আমরা বুঝি একাধিক ব্যক্তির সমষ্টি যারা একটি স্বীকৃত সংগঠনের মাধ্যমে পরস্পরের উপর কার্য করে; যথা: রাজনৈতিক দল, ছাত্রদল, কৃষক দল ইত্যাদি।
আরও পড়ুন: লোকনীতি কি | লোকনীতি কাকে বলে
গোষ্ঠী বা দলের সংজ্ঞা
সমাজবিজ্ঞানের একটি অন্যতম মৌলিক প্রত্যয় হলো সামাজিক গোষ্ঠী বা দল। গোষ্ঠী বা দল গড়ে উঠে কতিপয় ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে গোষ্ঠী চেতনাবোধ বেশ প্রবল থাকে এবং এই চেতনাবোধ গোষ্ঠীভুক্ত সবাইকে একটি ঐকতানে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষের সমস্ত জীবন জুড়ে পরিব্যাপ্ত থাকে সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা। মানুষ তার সমাজ ও সংস্কৃতির নানাদিক, নানা বৈশিষ্ট্য অনুভব করতে পারে সামাজিক গোষ্ঠীর মাধ্যমে। বস্তুত এসব সামাজিক গোষ্ঠী হলো মানুষের বিচিত্রমুখী সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনের আধারস্বরূপ।
যে কোন সংখ্যক ব্যক্তি যাদের একটি সাধারণ স্বার্থ রয়েছে এবং স্বার্থের কারণে যারা পরস্পর পরস্পরের অভিজ্ঞতায় কম বা বেশি মাত্রায় শরীক হয়, এমন একটি সমষ্টিকেই দল বা গোষ্ঠী বলে। সংক্ষেপে বলা যায়, পরস্পরের সাথে দৃষ্টি আকর্ষণের উপযোগী সুসামঞ্জস্য সম্পর্কে আবদ্ধ একদল ব্যক্তির সমষ্টিকে দল বা গোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করা যায়।
সমাজবিজ্ঞানী জিসবার্ট (Gisbert) এর মতে, “A social group is a collection of individuals interacting on each other under a recognizable structure.” অর্থাৎ, সামাজিক দল হলো ব্যক্তির সমষ্টি, যারা একটি স্বীকৃত সংগঠনের মধ্য থেকে পরস্পরের উপর কাজ করে।
টি. বি. বটোমর (T. B. Bottomore) তাঁর ‘Sociology’ গ্রন্থে বলেছেন, “A social group may be defined as an aggregate of individuals in which (i) definite relations exist between the individuals comprising it and (ii) each individual is conscious of the group itself and its symbols.” অর্থাৎ, একটি সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত এক মানবগোষ্ঠীই হলো সামাজিক গোষ্ঠী। এই মানবগোষ্ঠীর একটি মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি সমস্ত সদস্যদের মধ্যে বিদ্যমান।
সমাজ মনোবিজ্ঞানী Kimball Young গোষ্ঠীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “For our purpose we shall define a group as two or more persons in a state of social interaction.” অর্থাৎ, সমাজিক মিথস্ক্রিয়ার সম্পর্কে যুক্ত দুই বা ততোধিক ব্যক্তিকে দল বা গোষ্ঠী বলে গণ্য করা হয়।
Marshal Jones এর মতে, “A social group is two or more people between whom there is an established pattern of interaction.”
According to Ogburn and Nimkoff, “Whenever two or more individuals come together and influence one another, they may be said to constitute a social group.”
সমাজবিজ্ঞানী Robert Merton-এর ভাষায়, “গোষ্ঠী হচ্ছে এমন কিছু লোকের সমষ্টি যারা একে অপরের সাথে স্বীকৃত ও নির্দিষ্ট ধারায় বা প্রণালিতে মিথস্ক্রিয়ারত হয়, যারা মনে করে গোষ্ঠীরারাদ একটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং প্রণালিতে অন্যেরা মনে করে যে তারা একটি সদস্য।”
উপর্যুক্ত সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে বলা যায় যে, পারস্পরিক চেতনা সমৃদ্ধ এবং একই উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত দুই বা ততোধিক ব্যক্তির সমষ্টি যখন তারা সামাজিক মিথস্ক্রিয়ারত হয় এবং একটি বিধিবদ্ধ নিয়ম-শৃঙ্খলা দ্বারা পরিচালিত হয় তখন তাকে সামাজিক গোষ্ঠী বলা হয়। বহুবিধ সামাজিক গোষ্ঠীর মিলনেই সৃষ্টি হয় এই জটিল কাঠামোর। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্য দিয়েই মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে তার সমস্ত জীবন অতিবাহিত করে থাকে।
গোষ্ঠী বা দলের বৈশিষ্ট্য
দল বা গোষ্ঠীর নিম্নরূপ বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হয়; যেমন-
১. পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া
দল বা গোষ্ঠীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া। সমষ্টিগতভাবে পারস্পরিক ক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলে দল হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে সুস্পষ্টভাবে মানসিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও দল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। অর্থাৎ গোষ্ঠী গঠনের পক্ষে ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনি ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকের মনেই নিজেকে ও অপরকে গোষ্ঠীভুক্ত বলে মনে করার প্রয়োজন রয়েছে।
২. একাত্মতা বোধ
যখন জনসমষ্টি একাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয় তখনই কেবল দল গঠন করা যেতে পারে। দলীয় মনোভাব অর্থাৎ দলের অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের মধ্যে একাত্মতা বোধ বা ‘আমরা বোধ’ হলো গোষ্ঠীর আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। ‘আমরা সকলে মিলে একটি একক’, অথবা ‘আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য’- সদস্যদের এরূপ মানসিকতাই দল গঠনে প্রয়োজন। এরূপ মনোভাব থাকলে অনেক ক্ষেত্রেই দৈহিক সান্নিধ্যেরও প্রয়োজন হয় না।
৩. আদর্শগত মিল
একই দলের অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের মধ্যে আদর্শগত মিল থাকায় তাদের আচরণের মধ্যেও অভিন্নতা পরিস্ফুট হয়ে উঠে। কাজেই দলীয় আচরণ বা কর্মকাণ্ডের একরূপতা গোষ্ঠীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলা যায়।
৪. দলবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধতা
স্বভাবতই মানুষ দলবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে সমাজে অবস্থান করতে চায়। এ গোষ্ঠীবদ্ধতা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যের একটি দিক বলা চলে। মানবজীবনের প্রতিটি স্তরেই সে সমমনাদের সাহচর্য কামনা করে।
৫. স্থায়িত্ব
দলের কালগত স্থায়িত্ব বা অবিচ্ছিন্নতা এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এক মুহূর্তের জন্য যদি জনসমাবেশ সৃষ্টি হয় এবং পরক্ষণেই যদি তা ভেঙে যায় তাহলে তাকে দল বা গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করা যায় না। সমষ্টিগত জীবনধারণের একটা স্থায়িত্ব বা অবিচ্ছিন্নতার প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে তাকে গোষ্ঠী বলা যায় না।
৬. চাহিদা বা উদ্দেশ্য
ব্যক্তির চাহিদা বা উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই দল গঠিত হয়। এক্ষেত্রে বলা যায়, গোষ্ঠীর আরো একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো গোষ্ঠীর মধ্যে একটা চাহিদা বা উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কামনা লুকায়িত থাকে। তা গোষ্ঠীগত প্রকৃতি দ্বারা নিরূপিত হয়।
1 comment
[…] আরও পড়ুন: গোষ্ঠী কাকে বলে, সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য […]
Comments are closed.