ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে ই.বি টেইলরের মতবাদ
ধর্ম হলো অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস। আর এই ধর্মের উৎপত্তির পিছনে রয়েছে বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিকদের বিভিন্নমুখী চিন্তা-ভাবনা। নিম্নে ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত ধারণাগুলো ব্যক্ত করা হলো:
ক. সর্বপ্রাণবাদ বা আত্মবাদ (Animism)
সর্বপ্রাণবাদ হলো মানুষের আত্মায় বিশ্বাস, যে আত্মা মৃত্যুর পর অশরীরী অবস্থায় যথেচ্ছ বিচরণ করতে পারে। আরো স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, আত্মার পুনরুত্থানে বিশ্বাসই হচ্ছে সর্বপ্রাণবাদ। সেজন্য এ মতবাদকে আত্মাবাদও বলা যেতে পারে।
ইবনে খালদুনের আসাবিয়া তত্ত্ব আলোচনা |
সর্বপ্রাণবাদের জনক হলেন ই.বি. টেলর। তিনি তাঁর বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, ধর্মের মূলে রয়েছে আত্মা সম্পর্কিত ধারণা। তাঁর মতে, আদিম মানুষ মনে করতো- দেহ ও আত্মা এ দু’য়ের সমষ্টি হলো মানবজীবন। আদিম মানুষ আত্মা সম্পর্কিত ধারণায় উপনীত হওয়ার ফলে ধর্মের উৎপত্তি হয়। নিদ্রিত অবস্থায় দেহ একস্থানে থাকা সত্ত্বেও স্বপ্নে বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করতে পারে। এটি হতে তাদের মনে দৃঢ় ধারণা জন্মে যে, মানুষের মধ্যে দুটি সত্তা রয়েছে। যে সত্তা দেহ পরিত্যাগ করে যথেচ্ছা বিচরণ করতে পারে সে সত্তা অধিক সক্রিয়। এ সত্তা এমন জড় পদার্থের দ্বারা গঠিত যা ব্যবহারিক জ্ঞানে যে জড় পদার্থের সঙ্গে আমরা পরিচিত তার তুলনায় অনেক বেশি সূক্ষ্ম এবং বায়বীয়। এ সত্তা হলো আত্মা। আত্মা অশরীরী অবস্থায় যথেচ্ছা বিচরণ করতে পারে। মৃত্যুর পর দেহ থেকে আত্মার চির বিচ্ছেদ ঘটে। দেহ মৃত্যুর পর বিনষ্ট হয় কিন্তু আত্মা দেহ থেকে মুক্ত হয়ে প্রেতাত্মারূপে বিরাজ করে মানুষের মাঝে প্রবেশ করে মঙ্গল ও অমঙ্গল করে। আদিম মানুষেরা স্বাস্থ্য, জরা, ব্যাধি এবং ব্যক্তিজীবনে অপরাপর ভালোমন্দের হেতু হিসেবে অশরীরী আত্মাকে দায়ী করতো। সেজন্য অশরীরী আত্মার সন্তুষ্টির জন্য আদিম মানুষ প্রার্থনা, বলি, উৎসর্গ প্রভৃতি আনুষ্ঠানিক পূজা-পার্বণ পালন করতো। এভাবে আদিম সমাজে মানুষের মনে আত্মা উপাস্য দেবতায় পরিণত হয়।
আদিম সমাজে আত্মার ধারণা কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মনুষ্যত্বর প্রাণী ও প্রাণহীন বস্তুতেও আত্মার ধারণা ছিল। সেজন্য পাথরে, পাহাড়ে, নদ-নদীতে, সাগরে, আকাশে-বাতাসে, চন্দ্র-সূর্যে, ভূকম্পনে, ঝড়-ঝঞ্ঝায়, গাছপালার অঙ্কুরোদগমে প্রভৃতিতে আত্মার প্রভাবিত ফলাফল রয়েছে বলে মনে করা হতো। এভাবে আদিম সমাজে মানুষের মনে আত্মা-পূজার ধারণা জন্মে। পরবর্তীকালে এ পূজার মাধ্যমেই ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে বলে ই.বি. টেলর মনে করেন।
আদিম মানুষ মনে করতো যে, ব্যক্তির জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় ব্যক্তির দেহমধ্যস্থ আত্মার জন্য, তেমনি সে চিন্তা করতো বস্তুবিশ্বের ঘটনাবলির জন্য দায়ী আত্মসম্পন্ন দেবদেবী বা কোন মহাশক্তি। সুতরাং সর্বপ্রাণবাদের প্রথম ভূমিকাটি নিঃশেষিত হয় আত্মা (Soul)-র আবিষ্কারে, দ্বিতীয় ধারাটি শুরু হয় বহির্বিশ্বের সমস্ত বস্তুর মধ্যে। বিশেষ শক্তির (Soul-like beings) সন্ধানে। এভাবে ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির জীবনে বস্তুবিশেষের মধ্যে আত্মার ধারণার জন্ম থেকে সর্বপ্রাণবাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। সর্বপ্রাণবাদ বিকাশের চূড়ান্ত স্তরে, বিশেষত দেবদেবী ও তন্নিম্নস্থ ভূতপ্রেতদের বশে আনতে গিয়ে আত্মা ও পারলৌকিক জীবনে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং শেষ পর্যন্ত এসব বিশ্বাস এক ধরনের সক্রিয় উপাসনায় পরিণত হয়।
টোটেম কি? টোটেম ও ট্যাবু কি? |
টেইলরের মতে, ধর্মের বিবর্তন হয়েছে এভাবে-
প্রেতাত্মায় বিশ্বাস→ পূর্বপুরুষ পূজা→ প্রকৃতি পূজা (বহু ঈশ্বরবাদ)→ একেশ্বরবাদ।
সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সার টেইলরের ধারণাকে সমর্থন করে তিনি তাঁর “Principles of Sociology” গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মানব মনে ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে ভূতের ভয় থেকে। আদিম মানুষ মনে করতো মৃত্যুর পর তাদের পূর্বপুরুষ ভূতে পরিণত হয়। তাদের বিশ্বাস- পূর্বপুরুষদের প্রেতাত্মা তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করছে। সেজন্য পূর্বপুরুষের প্রেতাত্মা দেবতার সম্মান লাভ করতো। এসব দেবদেবীর প্রতি বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতেই ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে।