ধর্মের সংজ্ঞা
ধর্মের স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে ধর্মের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। কোন কোন সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী ধর্মকে পার্থিব জগতের একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করেছেন। কারণ অতি প্রাচীন কাল থেকে সামাজিক কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
নৃবিজ্ঞানী ই. বি. টেলর বলেন, “Religion is the belief in super natural being.” ধর্ম হচ্ছে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস। ই. বি. টেলরের এ সংজ্ঞাকে সমালোচনা করে অনেকে বলেন, ধর্ম একটি বিশ্বাসের বস্তু বলে মেনে নেয়া গেলেও বিশ্বাস অপেক্ষা ধর্মে আরো বেশি কিছু রয়েছে।
নৃবিজ্ঞানী ফ্রেজার তাঁর বিখ্যাত “The Golden Bough’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “Belief in powers superior man which are believed to direct and control the course of nature and of human life.” অর্থাৎ, ধর্ম হচ্ছে অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস। আর এ শক্তি মানবজীবন ও প্রকৃতির ধারাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। তিনি ধর্মের দুটি মূল উপাদানের কথা উল্লেখ করেন- একটি হলো মানুষের চেয়ে উচ্চতর শক্তিতে বিশ্বাস এবং অপরটি হলো সে শক্তিকে তুষ্ট করার জন্য নানা ধরনের আরাধনা বা অনুষ্ঠান পালন করা।
ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে ই.বি টেইলরের মতবাদ |
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ডুরখেইম তাঁর The Elementary Forms of Religious Life’ নামক গ্রন্থে বলেন, “Religion is a unified system of beliefs and practices relative to sacred things.” অর্থাৎ, ধর্ম হলো পবিত্র বস্তু সম্পর্কিত কতকগুলো বিশ্বাস ও প্রথার সমষ্টি। ডুরখেইম সমীক্ষার মূলগত বিষয় হলো দুটি- বিশ্বাস ও আচার। তিনি জগৎ সংসারের এ দুটি ভাগের নাম দিয়েছেন- পবিত্র (Sacred) ও অপবিত্র বা পার্থিব (Profane)। দেবদেবী, মহাশক্তি ঈশ্বর, প্রেতাত্মা- এসব পবিত্র জগতের অঙ্গ। ধর্ম শুধু পবিত্র বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত। অপবিত্র বা পার্থিব বলতে তিনি মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে বুঝিয়েছেন। তিনি মনে করেন, পবিত্র জগৎ সম্পর্কে বিশ্বাস ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আচার পদ্ধতির দ্বারাই ধর্মের সৃষ্টি হয়।
নৃবিজ্ঞানী লোঈ (Lowie) ডুরখেইমের এ ধর্মীয় চিন্তাধারার সমালোচনা করে তাঁর গ্রন্থ ‘Primitive Religion’ এ ধর্মকে অসাধারণ ভীতিপ্রদ সত্তার প্রতি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া বলে মনে করেন।
লোঈ তাঁর সংজ্ঞার মধ্যে অতিপ্রাকৃতের সাথে মানব মনের বিশেষ প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছেন যা আমরা তাকে সাধারণ ও অসাধারণ- এ দু’য়ের ব্যবধান মনে করতে পারি। কারণ ধর্ম সম্পর্কিত আচার-ব্যবহার, লক্ষ্য ও কর্মসূচি বৃদ্ধির অগোচর এবং অস্পষ্ট। সে কারণেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানব মনে দুর্জেয় রহস্যের সৃষ্টি হয়; এ প্রসঙ্গে এম. রেভাইলের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “ধর্ম হলো রহস্যাবৃত মনের সাথে মানব মনের সম্পর্ক সৃষ্টির ভাবানুভূতিগত বন্ধনের নির্ধারণী। বিশ্ব ও ব্যক্তির উপর উক্ত শক্তির প্রভাবকে ব্যক্তি স্বীকার করে নেয় এবং সে মহাআত্মার সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা ভেবে ব্যক্তিমন পুলকিত হয়।”‘ কাজেই ধর্মের মূলভিত্তি অতিপ্রাকৃত সত্তায় বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের ফলে মানব মনে ধর্ম বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
আবার কার্ল মার্কস বলেন, “ধর্ম জনগণকে তন্দ্রাবিষ্ট করে রাখে।” ধর্ম মানুষেরই সৃষ্টি। বস্তুত সমাজ ও রাষ্ট্রই ধর্মকে সৃষ্টি করে। কারণ তা মানব মনের একটি বিশেষ প্রতিক্রিয়া।
উপর্যুক্ত আলোচনা হতে আমরা বলতে পারি যে, বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। সেজন্য এর অভিন্ন সংজ্ঞা নিরূপণ করা দুঃসাধ্য। যারা ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেছেন তাদের নিকট ধর্ম হলো অতিপ্রাকৃত সত্তায় বিশ্বাস। ধর্ম সেক্ষেত্রে আশীর্বাদস্বরূপ বলে মনে হয়। কারণ ধর্মের অস্তিত্ব না থাকলে জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। আবার যারা ধর্মের নেতিবাচক ব্যাখ্যা করেন তাদের নিকট ধর্ম হলো অলীক দর্শন।