যে কোন দলীয় পরিস্থিতিতে দলের লক্ষ্য অর্জন ও সদস্যদের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের দলের প্রভাব সৃষ্টিকারী আচরণকে সাধারণত নেতৃত্ব বলে উল্লেখ করা হয়। নেতৃত্বের উৎস, নেতার ব্যক্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য ও নেতার কার্যাবলির উপর নির্ভর করে নেতৃত্বকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা নেতৃত্ব অনুধ্যানের একটি প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি। এ ধরনের শ্রেণিকরণ বিভিন্ন প্রকার নেতৃত্ব সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে থাকে।
আরও দেখুন: নেতৃত্ব কি | নেতৃত্ব কাকে বলে
নেতৃত্ব কত প্রকার
নেতৃত্ব কত প্রকার তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কারণ দলীয় কাঠামোর উপর ভিত্তি করে নেতৃত্বকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। নিম্নে নেতৃত্বের কয়েকটি শ্রেণিবিভাগ করে দেখানো হলো-
১। সমাজজীবনের পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে নেতৃত্বকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
ক) রীতিসিদ্ধ নেতৃত্ব,
খ) প্রকৃত নেতৃত্ব।
২। নেতা ও দলের সদস্যদের মধ্যে সংযোগের দৃষ্টিভঙ্গি থেক নেতৃত্বকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
ক) প্রত্যক্ষ সংযোগ বিশিষ্ট নেতৃত্ব,
খ) পরোক্ষ সংযোগ বিশিষ্ট নেতৃত্ব।
৩। মনোবিজ্ঞানী Lewin, Lippit এবং White এর মতানুযায়ী নেতৃত্ব তিন প্রকার। যথা-
ক) প্রভুত্বব্যঞ্জক নেতৃত্ব,
খ) গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব,
গ) স্বল্প নিয়ন্ত্রণ বিশিষ্ট নেতৃত্ব।
৪। নেতৃত্বের সাধারণ শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে-
ক) প্রভুত্বব্যঞ্জক নেতৃত্ব,
খ) গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব,
গ) প্রশাসনিক নেতৃত্ব,
ঘ) আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব,
ঙ) ঐশ্বরিক বা অলৌকিক নেতৃত্ব,
চ) সংস্কারক,
ছ) Expert
জ) Elite নেতৃত্ব।
৫। প্রচলিত ধারণার ভিত্তিতে নেতৃত্বের শ্রেণিবিন্যাস নিম্নরূপ-
ক) আরোপিত,
খ) অর্জিত।
নেতৃত্বের কয়েকটি বিশেষ ধরন সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. প্রভুত্বব্যঞ্জক নেতৃত্ব (Authoritarian Leadership)
প্রভুত্বব্যঞ্জক নেতৃত্ব হচ্ছে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে নেতা নীতিমালা প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে সকল ব্যাপারে নিজের মতামতকে প্রাধান্য দেন। এ ধরনের নেতা অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। বস্তুত প্রভুত্বব্যঞ্জক নেতৃত্বে নেতাই সর্বেসর্বা, চরম ও পরম ক্ষমতার অধিকারী এবং শাস্তি ও পুরস্কার প্রদান করার একমাত্র মালিক।
২. গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব (Democratic Leadership)
গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে নেতা হলেন সকল সদস্যের আদর্শস্বরূপ। তিনি গোষ্ঠীর সদস্যদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন এবং সকলের মতামতের ভিত্তিতে লক্ষ্য, আদর্শ ও নীতি ঠিক করেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গণতান্ত্রিক নেতা খুবই ধৈর্যশীল, বিচক্ষণ এবং গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার প্রতীকস্বরূপ বিধায় তাকে সকলে মান্য করেন।
৩. প্রশাসনিক নেতৃত্ব (Administrative Leadership)
প্রশাসনিক নেতা কোন প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু এবং তিনি বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত। তিনি মূলত তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা, পরিকল্পনা ও সংগঠনের জন্য কাজ করেন এবং তাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করেন।
আরও দেখুন: ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর
৪. ঐশ্বরিক নেতৃত্ব (Charismatic Leadership)
এ ধরনের নেতৃত্বে নেতা তার ব্যক্তিগত গুণাবলি, আদর্শ ও মূলবোধ দিয়ে অন্যের কাছে ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও পূজনীয় ব্যক্তি হিসেবে প্রতিভাত হন। Max Weber এ ধরনের নেতা ও তার গুণাবলি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। অনুগামীরা এ ধরনের নেতার মতাদর্শের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে নেতার সাথে কাজ করতে সচেষ্ট থাকে। এ ধরনের নেতা হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স), যীশু খ্রিস্ট প্রমুখের নাম বলা যায়।
৫. আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব (Bureaucratic Leadership)
প্রশাসনিক উচ্চক্রমের কোন এক বিশেষ অবস্থানে যে নেতৃত্ব অবস্থান করে তাকেই আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব বলে। এ ধরনের নেতৃত্ব সুষ্ঠু ক্ষমতার বিন্যাস নির্ভর এবং ক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট রূপরেখায় পরিচালিত। নিয়মতান্ত্রিকভাবে এটি পরিচালিত হয় বিধায় Max Weber একে Legal Rational Bureaucratic Leadership’ বলে অভিহিত করেছেন।
৬. বিশেষজ্ঞ (Expert)
এসব নেতারা নিজেদের বিষয়ে পারদর্শী। বিজ্ঞান, শিল্পকলা বা অন্য কোন বিষয়ে সৃজনশীল কুশলতার অবদানে বরেণ্য ব্যক্তিদেরও স্ব স্ব ক্ষেত্রে নেতা বলা হয়ে থাকে। পদার্থবিজ্ঞানে আইনস্টাইন, কাব্যে রবি ঠাকুর, শেক্সপিয়ার এ ধরনের নেতৃত্বের উদাহরণ।
৭. বুদ্ধিজীবী নেতা (Intellectual Leader)
চিন্তা জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বুদ্ধিজীবী তাত্ত্বিকেরা এ পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। যেমন- কার্ল মার্কস, ডারউইন, জেফারসন, লেনিন, উড্রো উইলসন, বেনজামিন, ফ্রাংকলিন প্রমুখ তাত্ত্বিকেরা তাঁদের চিন্তাচেতনা, মেধা ও মননের সম্মিলনে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হয়েছেন।
৮. এলিট নেতৃবৃন্দ (Elite Leaders)
বর্তমান সমাজে বিভিন্ন পেশায় সক্ষম, পারদর্শী ও উৎকৃষ্ট পর্যায়ের কিছু ব্যক্তিকে Elite বলা হয়; যারা শিক্ষা, রাজনীতি, সামাজিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার সাথে কাজ করে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করেন।
৯. সংস্কারক (Reformer)
সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার কোন বিশেষ দিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করা সমাজ সংস্কারমূলক নেতৃত্বের অন্যতম কাজ। এসব নেতাগণ চিন্তা ও চেতনে এক বৈপ্লবিক জাগরণ এনে সমাজের গতানুগতিক কাঠামোর পরিবর্তন আনেন। বেগম রোকেয়া, আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার, ক্যালভীন, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং আরো অনেক নেতা সংস্কারমূলক কাজের জন্যই বেশি পরিচিত
১০. আরোপিত নেতৃত্ব এবং অর্জিত নেতৃত্ব (Ascribed Leadership and Achieved Leadership)
যখন নেতৃত্ব গোষ্ঠীর উপর বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া হয় তখন সেই নেতৃত্বকে বলা হয় আরোপিত নেতৃত্ব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সৈন্যাধ্যক্ষের নেতৃত্ব তার উপর আরোপ করা হয়। যখন নেতৃত্ব গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত হয়, তখন সেই নেতৃত্বকে অর্জিত নেতৃত্ব বলা হয়। কোন একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতির নেতৃত্ব হলো অর্জিত নেতৃত্বের উদাহরণ। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, নেতৃত্বের প্রকরণ সম্পর্কে সবাই একমত নন এবং সর্বজনগ্রাহ্য নেতৃত্বের শ্রেণিবিভাগ পাওয়া যায় না। তাই বিভিন্ন গ্রন্থে নেতৃত্বের প্রকরণ বিভিন্নরূপে লক্ষ করা যায়। তবে উপর্যুক্ত প্রকরণগুলোই সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত এবং প্রকৃতপক্ষে গৃহীত।
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে আপনারা নেতৃত্ব কত প্রকার ও কি কি সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেলেন।