পরিবার কাকে বলে
পরিবার বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি যে, বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক যৌথভাবে বসবাস করার একটি সংগঠন। আবার অনেকে মনে করেন যে, পরিবার যৌন সম্পর্ক দ্বারা গঠিত এমন একটি নির্দিষ্ট জুটি যা পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান করে সন্তান প্রসবের এবং প্রতিপালনের। অতএব স্বামী এবং স্ত্রীর বন্ধন দ্বারাই পরিবারের সৃষ্টি।
পরিবারের ইংরেজি ‘Family’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Familia’ এবং রোমান শব্দ ‘Famulus’ থেকে এসেছে। উভয়ের অর্থ হচ্ছে Servant বা সেবক। Roman Law System অনুযায়ী পরিবার বলতে উৎপাদক, ভৃত্য ও অন্যান্য সদস্য নিয়ে গঠিত এমন একটি গোষ্ঠী যারা অভিন্ন বংশ বা বিবাহের দিক থেকে পারস্পরিক সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী এম. এফ. নিমকফ (M. F. Nimkoff) তাঁর ‘Marriage and the Family’ গ্রন্থে পরিবারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন যে, “Family is a more or less durable association of husband and wife with or without children or of a man or woman alone or with children.” অর্থাৎ, পরিবার মোটামুটিভাবে স্বামী এবং স্ত্রী দ্বারা সৃষ্ট একটি সংঘ, যেখানে সন্তান– সপ্ততি থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে।
ম্যাকাইভার ও পেজ (Maclver and Page) তাঁদের ‘Society : An Introductory Analysis’ শীর্ষক গ্রন্থে অভিমত ব্যক্ত করেন, “Family is a group defined by sex relationship sufficiently precise and enduring to provide for the procreation and upbringing of children. অর্থাৎ, সুনির্দিষ্ট যৌন সম্পর্কের ভিত্তিতে এবং সন্তান–সন্ততি জন্মদান ও তাদের লালন– পালনের জন্য যথার্থ ও স্থায়ী গোষ্ঠীকে পরিবার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
এলিয়ট ও মেরিল (Eliot and Merrill) পরিবারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,
“Family is the biological social unit composed of husband, wife and
children.” অর্থাৎ, পরিবার হলো স্বামী, স্ত্রী এবং সন্তান–সন্ততি দ্বারা গঠিত একটি
জৈবিক সামাজিক একক।
ই.ডব্লিউ. বারজেস ও এইচ.জে. লক (E. W. Burgess and H. J. Locke) তাঁদের ‘The Family’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “Family is a group of persons united by the ties of marriage, blood or adoption; constitution a single household interacting and intercommunicating with each other in their respective social roles of husband and wife, mother and father, son and daughter, brother and sister creating a common culture.” অর্থাৎ, পরিবার হলো ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে এমন একটি গোষ্ঠী যার সদস্যরা বিবাহ বন্ধন, রক্তের সম্পর্ক বা দত্তকসূত্রে সংঘবদ্ধ হয় এবং পারস্পরিক ক্রিয়া ও আন্তঃযোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে একত্রে বসবাস করে। ভক্তিপূর্ণ সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে স্বামী–স্ত্রী, মাতাপিতা, পুত্র–কন্যা, ভাইবোন মিলেমিশে অভিন্ন সংস্কৃতি সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুন: নৃবিজ্ঞান কি বা কাকে বলে? নৃবিজ্ঞান এর জনক কে?
ডেভিড পপেনো (David Popenoe) এর মতে, “Family is a group of ‘kin’ who live together and function as a co-operative unit for economic or other purposes.” অর্থাৎ, পরিবার হলো জ্ঞাতিভিত্তিক গোষ্ঠী যারা একসাথে বসবাস করে এবং অর্থনৈতিক বা অন্যান্য উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে সহযোগিতামূলক একক হিসেবে কাজ করে ।
লুসি মেয়ার (Lucy Maire) এর মতে, “The family is the institution within is the cultural tradition of a society is handed down to the new generation.”
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলো দ্বারা আমরা পরিবারকে সহজ করে বুঝতে পারি। কারণ পরিবারের লোকেরা একে অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ; তাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক বিদ্যমান। রক্তের সম্বন্ধই পরিবারের মূলভিত্তি এবং ঐক্যসূত্র। অতএব বলা যায়, পরিবার হলো একটি সামাজিক সংগঠন যা দ্বারা পুরুষ ও স্ত্রীলোক যুক্তিযুক্তভাবে একতাবদ্ধ হয়ে সন্তান প্রসবের সুযোগ প্রদান করে এবং রক্ত সম্পর্কের মাধ্যমে পরস্পর পরস্পরের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে।
পরিবারের বৈশিষ্ট্য
পরিবারের মাঝে আমরা কতকগুলো বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই; যেমন– ম্যাকাইভার ও পেজ তাঁদের গ্রন্থ ‘Society তে পরিবারের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন। এবং তাঁদের মতে এ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য সদা বিদ্যমান বলে উল্লেখ করেন। এ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো :
১. যুগল সম্পর্ক,
২. বিবাহের মাধ্যমে নারী–পুরুষের মধ্যে স্থায়ী যৌন সম্পর্ক সৃষ্টি,
৩. বংশানুক্রমে পরিবারের বিকাশ লাভ,
৪. সাধারণ বাসস্থান বা একই গৃহে অবস্থান ও
৫. একটি অর্থনৈতিক পদ্ধতির মাধ্যমে গোষ্ঠী পরিচালনা।
তাঁদের মতে, এ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য ছাড়া পরিবারের কথা চিন্তা করা যায় না। তবে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য ব্যতিরেকে আরো কতিপয় বৈশিষ্ট্য যোগ হতে পারে। যেমন–
১. পরিবারের সদস্যদের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে,
২. প্রত্যেক পরিবারের একটি নিজস্ব নাম বা পরিচিতি আছে,
৩. সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে হয়,
৪. পরিবার সামাজিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় অংশ,
৫. এটি বিশ্বজনীন,
৬. সহযোগিতার নীতি বিদ্যমান।
সুতরাং এখন দেখা যাচ্ছে যে, বিবাহ পরিবার গড়ে উঠার প্রধান সহায়ক; যেমন– সমাজবিজ্ঞানীগণ পুরুষ ও স্ত্রী নানারূপ ছুটি ও জাতি সম্পর্কের উপর নির্ভর করে পরিবারকে বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন নামকরণ করেছেন।
পরিবারের প্রকারভেদ
আমরা পরিবারের কাঠামো বিশ্লেষণ করলে যুক্তিসিদ্ধভাবে পরিবারের প্রকারভেদকে জানতে পারব। সমাজবিজ্ঞানীগণ বিবাহ পদ্ধতির ভিত্তিতে পরিবারকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যথা:
১. একপতি–পত্নীক পরিবার (Monogamy): একপতি–পত্নীক পরিবার বলতে সেই পরিবারকে বুঝায় যেখানে একজন পুরুষ কেবল একজন স্ত্রীলোকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দু‘জনে যৌথভাবে বসবাস করে।
২. বহুপত্নীক পরিবার (Polygamy): বহুপত্নীক পরিবার বলতে সেই পরিবারকে বুঝায় যেখানে একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকে।
৩. বহুপতি পরিবার (Polyandry): বহুপতি পরিবার হলো যেখানে একজন স্ত্রীলোকের একাধিক স্বামী থাকে ।
৪. গোষ্ঠী পরিবার (Family based on Group marriage): গোষ্ঠী পরিবার হলো দুই বা ততোধিক পুরুষ একত্রে দুই বা ততোধিক স্ত্রীলোককে নিয়ে যৌন কামনা মিটিয়ে থাকে । এটা সাধারণত দলের বা গোষ্ঠীর সমন্বয়ে হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: নৃবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর
এছাড়া আমরা বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে পরিবারের বিভিন্নভাবে প্রকারভেদ করতে পারি। যেমন–
১. প্রভুত্বের মাপকাঠি অনুযায়ী (Measure of lordship): প্রভুত্বের মাপকাঠি অনুযায়ী পরিবারকে দু‘ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
ক. মাতৃতান্ত্রিক পরিবার (Matriarchal family): মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে স্ত্রীলোকের অধিকার পুরুষের চেয়ে বেশি থাকে এবং স্ত্রীলোকের মাধ্যমে বংশ
পরিচয় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। মিশর, তিব্বত ও দক্ষিণ ভারতে এ ধরনের পরিবার বিদ্যমান ছিল। এখনো দক্ষিণ ভারত, কোচিন, মালাবার প্রভৃতি স্থানে
মাতৃতান্ত্রিক পরিবার বিদ্যমান রয়েছে।
খ. পিতৃতান্ত্রিক পরিবার (Patriarchal family): পিতৃতান্ত্রিক পরিবার হলো সেই শ্রেণির পরিবার, যেখানে পুরুষের মাধ্যমে বংশ পরিচয় নির্ধারণ করা হয়। এবং পুরুষ মানুষকে পরিবারের কর্তা বলে স্বীকার করা হয়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের সকল দায়িত্ব পুরুষের হাতে ন্যস্ত থাকে। ফলে পরিবারের ভরণপোষণ এবং নিরাপত্তার জন্য পুরুষই দায়ী থাকে।
পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই এ ধরনের পরিবারের স্বীকৃতি অধিক লক্ষ করা যায়। এজন্য বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী স্যার হেনরি মেইন বলেছেন যে, পিতৃতান্ত্রিক পরিবারই আদিম পরিবার ছিল। আমরা প্রাচীন রোমে সর্বপ্রথম আদর্শ পিতৃতান্ত্রিক পরিবার বিদ্যমানতার প্রমাণ পাই। যেমন– রোমান প্যাট্রিয়ার্ক কেবল পরিবারের প্রধান ছিলেন না, তাঁর অধীনস্থ লোকজনের নিকট তিনি ছিলেন একাধারে ধর্মগুরু, শাসক এবং প্রধান উপদেষ্টা। আইনের চোখে তাকেই পরিবারের বৈধ প্রতিনিধি বলে গণ্য করা হতো। পরিবারের লোকজনের উপর তাঁর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বলবৎ ছিল। ফলে প্রাচীন রোমে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল।
অবশ্য কোন কোন দেশে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারই ছিল আদিমতম পরিবার। আবার কোন কোন দেশে আদিমতম পরিবার ছিল মাতৃতান্ত্রিক পরিবার।
২. স্বামী–স্ত্রীর সংখ্যা অনুযায়ী (Number of spouses): কোন কোন পরিবারে পুরুষ ও স্ত্রীলোকের প্রভুত্বের উপর ভিত্তি করে সেই পরিবারের স্ত্রী বা স্বামী একাধিক স্ত্রী বা স্বামী নিয়ে পরিবার গঠন করতো। সে পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকার পরিবার গড়ে উঠেছে; যেমন–
ক. একপতি–পত্নীক পরিবার (Monogamy): যখন একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক যৌথভাবে পরিবার গঠন করে তখন তাকে একপতি–পত্নীক পরিবর বলা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এটি আর্থিক কারণে হোক বা সুখশান্তির কারণেই হোক বর্তমানে এর প্রচলন সর্বাপেক্ষা অধিক লক্ষ করা যায়।
খ. বহুপত্নীক পরিবার (Polygamy): যখন একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রীলোক নিয়ে পরিবার গঠন করে তখন একে বহুপত্নীক পরিবার বলা হয়।
গ. বহুপতি পরিবার (Polyandry): এ ধরনের পরিবারে একজন স্ত্রীলোকের একাধিক স্বামী থাকে। প্রাচীন তিব্বতে ও ভারতের কোন কোন স্থানে এ প্রকার পরিবার এখনো বিদ্যমান রয়েছে । কিন্তু বর্তমানে এর অস্তিত্ব অনেকটা লোপ পাচ্ছে।
৩. বাসস্থানের অধিকার অনুযায়ী (Right of dwelling-house): স্বামী ও স্ত্রীর বাসস্থানের অধিকার অনুযায়ী পরিবারের প্রকারভেদ অনুমান করতে দেখা যাচ্ছে; যেমন–
ক. মাতৃবাসস্থান পরিবার ( Matriarch family): এরূপ পরিবারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পাত্র স্বীয় পৈতৃক বাসস্থান বা পৈতৃক পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাত্রীর পরিবারভুক্ত হয়ে বাস করে।
খ. পিতৃবাসস্থান পরিবার ( Patriarch family): এরূপ পরিবারের নিয়ম হলো পাত্রী বিবাহ বন্ধনের পর পিতার বাসস্থান বা পৈতৃক সম্পত্তির মালিকানা বা অংশীদার নাও থাকতে পারে। সাধারণত দেখা যায়, পাত্রী বিবাহ বন্ধনের পর পাত্রের পরিবারভুক্ত হয়ে যায় এবং সেখানেই তার অধিকার গণ্য করা হয়।
এছাড়া সমাজবিজ্ঞানীগণ বংশানুক্রমে পরিবারের প্রকারভেদ নির্দেশ করেছেন। যেমন– পিতৃস্বীকার্য ও মাতৃস্বীকার্য পরিবার।
আরও পড়ুন: নৃবিজ্ঞানের শাখা সমূহ আলোচনা কর
ক. পিতৃস্বীকার্য পরিবার বা পিতৃসূত্রীয় পরিবার (Patrilineal family): যে পরিবারের সন্তানগণ তাদের পরিবারের পরিচয় পিতার বংশ অনুযায়ী নির্ধারণ করে থাকে তাকে পিতৃস্বীকার্য পরিবার বলা হয়। আরো স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, পরিবারে অধিকারের সূত্র অনুযায়ী পরিবারের সন্তানগণ সে অধিকার ভোগ করে থাকে। যেমন– মাতা যদি একজাতির অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পিতা যদি অন্যজাতির অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে এ প্রকার পরিবারের পিতার জাতির উপাধি ও বংশমর্যাদা অনুযায়ী সন্তানদের বংশমর্যাদা নিরূপণ করা হয়।
খ. মাতৃস্বীকার্য পরিবার বা মাতৃসূত্রীয় পরিবার ( Matrilineal family): পরিবারের সদস্যগণ যদি মায়ের বংশমর্যাদা অনুযায়ী সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তাকে মাতৃস্বীকার্য মাতৃসূত্রীয় পরিবার বলা হয়।
অবশ্য এ প্রকার পরিবার সাধারণত পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
পরিশেষে বলা যায় যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমাজব্যবস্থায় বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন পরিবার দেখা যায়। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে ক্রমে অণু পরিবার সৃষ্টি হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের সমাজব্যবস্থায় এখনো ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে হলেও যৌথ পরিবার ব্যবস্থা দেখা যায়।