পুঁজিবাদ কি বা কাকে বলে?
পুঁজিবাদ হচ্ছে সমাজের এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি গড়ে তোলার ও ব্যবসায় দ্বারা অবাধ মুনাফা লাভের স্বাধীনতা থাকে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ধনদৌলতের মালিকানার নির্দিষ্ট কোন ধরাবাঁধা নিয়ম না থাকায় মানুষ ব্যক্তিগত ইচ্ছায় সম্পত্তি বাড়িয়ে সমাজে ধনী বলে আত্মপ্রকাশ করে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি পুঁজিবাদী সমাজের প্রকৃত রূপ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমগ্র সামাজিক কাঠামো ব্যক্তিগত মালিকানার উপর গড়ে উঠে। সমাজে ধনিক শ্রেণির একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা যায়।
সমাজবিজ্ঞানী Sidney Webb এর মতে, পুঁজিবাদ বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বা পুঁজিবাদী সভ্যতা মানে সমাজের উন্নতির একটি স্তর যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার দ্বারা উৎপাদন ব্যবস্থা, কলকারখানা ও শ্রমিকদের শ্রম নিয়ন্ত্রিত করা যায়। মালিকের উৎপাদিত দ্রব্যের একচেটিয়া অধিকার থাকে। শ্রমিকগণ উৎপাদন করে কিন্তু উৎপাদিত দ্রব্যের উপর তাদের মালিকানা থাকে না এবং তারা অবাধ মুনাফা থেকে বঞ্চিত হয়।
আবার Prof. Pigou এর মতে, উৎপাদিত যন্ত্রপাতির মালিক ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকারবলে শ্রমিক দ্বারা উৎপাদন করে এবং অবাধ মুনাফা করার প্রবৃত্তি নিয়ে শ্রমিকদের দ্বারা উপাদন বৃদ্ধি করে। বস্তুতপক্ষে শ্রমিকগণ মালিকের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। সুতরাং পুঁজিবাদ বলতে আমরা বুঝি যে, মেহনতি জনতার শ্রম দ্বারা পুঁজিপতির সৃষ্টি হয় এবং এই পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে।
আরও পড়ুন: গোষ্ঠী কাকে বলে, সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কিছুসংখ্যক ধনী অভিজাত ও ভূ-স্বামী উৎপাদন যন্ত্রকৌশল ও পদ্ধতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে শ্রমিকদের দ্বারা পরিচালনা করে এবং নিম্নতম মজুরিতে শ্রমিকদের কলকারখানায় কাজ করতে বাধ্য করে। এ ব্যবস্থায় সমগ্র সামাজিক কাঠামো, সামাজিক শ্রেণিমর্যাদা, রীতিনীতি, প্রতিষ্ঠান, অনুষ্ঠান প্রভৃতির কাজ ব্যক্তিগত মালিকানার দ্বারা গড়ে উঠে।
Capital শব্দটি ১৬৮০ সালে Cotgrave ব্যবহার করেন, যার প্রকৃতি Wealth, Stock ও Substance অর্থাৎ কোন জিনিস বা সম্পদের মজুদ যা মানুষের জন্য Principal Substance বা অস্তিত্বের নিয়ামক।
Ebenstein এর মতে, “The concept of capitalist civilization is a legitimate one its suggests that capitalism is more than a particular type of economy, that is a whole system.”
Latin ‘Caput’ (Money, instrument, credit) শব্দ থেকে ১৭ শতকে Caput Capital Captalist Capitalism এর এভাবে ব্যবহার শুরু। Arthur Young ১৭৯২ সালে ব্যবহারের পর ১৮৫৪ সাল থেকে প্রত্যয় হিসেবে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা পায়। Karl Marx, Engels ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত ‘Communist Manifesto’ তে Capitalist, Capitalistic এর চেয়ে Bourgeoisie বা Bourgeois বেশি ব্যবহার করেন। Marx ১৮৭৭ সালে তার এক সহযোগীর কাছে পত্রের মাধ্যমে প্রথম Capitalism শব্দটি ব্যবহার করেন কিন্তু এর কোন সুস্পষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করেন নি। Lenin ই প্রথম এর সংজ্ঞা প্রদানের চেষ্টা করেন।
Joseph Sehumpeter তাঁর ‘The March into Socialism’ প্রবন্ধে বলেন, “Capitalism is a scheme of values and attitude towards a life and the civilization of inequality and of the family fortune.”
সর্বশেষে Lenin কর্তৃক প্রদত্ত যথার্থ উদ্ধৃতিটি হচ্ছে, “By capitalism is meant that stage of development of commodity production at which not only the products of human labour but human labour power itself becomes a commodity.”
Capitalism এর স্তর:
a. Commercial Capitalism → Market
b. Industrial Capitalism → Industry, Factory
c. Financial Capitalism →Bank, Insurance
উপরের তিনটি স্তর Mutually exclusive নয়।
Capitalism বলতে শিল্পভিত্তিক সমাজকে বুঝায়। Industry ছাড়া Capitalism হয় না।
পুঁজিবাদের উৎপত্তি সম্বন্ধে আমরা দুটি প্রধান মতবাদ লক্ষ করে থাকি; যেমন- ম্যাক্স ওয়েবার মত পোষণ করেন যে, সমাজে পুঁজিবাদ গড়ে উঠার কারণ হলো সামাজিক মানুষের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি মনে করেন যে, মানুষ যখন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়ে তখন বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন হয়ে উঠে এবং জীবনযাত্রার উন্নয়নের জন্য সম্পদ আহরণের ব্যবস্থা করতে বাধ্য থাকে। এছাড়া ধর্মীয় নির্দেশানুযায়ী মিতব্যয়ী হওয়ার প্রেরণা যোগায়। তিনি প্রোটেস্টান্টাইনদের কথা উল্লেখ করে দেখান যে তাদের ধর্মীয় বুদ্ধি বিকাশের সাথে সাথে পুঁজি বৃদ্ধির সামঞ্জস্য রয়েছে।
অপরপক্ষে, কার্ল মার্কস বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে পুঁজিবাদের কথা উল্লেখ করেন। মার্কসের মতে, উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও কলকারখানা বৃদ্ধির জন্যই পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছে। বস্তুতপক্ষে বর্তমান সমাজের দিকে লক্ষ করলে আমরা কার্ল মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গির সত্যতা খুঁজে পাই। ম্যাক্স ওয়েবারের মতবাদ নির্দিষ্টকালের ঘটনা বা পুঁজিবাদের উৎপত্তির একটা কারণ বলে মনে করতে পারি।
আরও পড়ুন: কার্ল মার্কসের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর
কার্ল মার্কস মনে করতেন যে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে অনেকগুলো শক্তির সমন্বয়ে; যেমন- বাণিজ্য পুঁজির আবির্ভাব, মুদ্রা খাটিয়ে মুদ্রা অর্জনের পুঁজির আবির্ভাব, কাঁচামালকে দক্ষতাসহকারে ব্যবহার করে অন্য বস্তুতে রূপান্তরিত করার বৃহত্তর সম্ভাবনা সৃষ্টি; ক্রমবর্ধমান হারে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিটি মুদ্রার মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার প্রথার বিকাশ, শ্রম কিংবা দ্রব্য খাজনার দ্রব্য খাজনায় রূপান্তর ইত্যাদি। উপর্যুক্ত প্রক্রিয়াসমূহের মিথস্ক্রিয়ায় প্রজাভিত্তিক কৃষিকার্যের বিকাশ ঘটল, স্বাধীন সম্পত্তির মালিক হিসেবে কৃষকের আবির্ভাবের দরুন কৃষিক্ষেত্রে দিনমজুর শ্রেণির উদ্ভব হলো এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হলো।
বাণিজ্য পুঁজির বিকাশটা বাজার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মানানসইভাবে বিকশিত হয়েছে। তৎসঙ্গে সমাজের সামগ্রিক অর্থনীতিও ক্রমশই মুদ্রাভিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের উৎপাদন পদ্ধতিতে মুদ্রা বিরাট পরিবর্তন সাধন করে এবং তার চরিত্রটিও সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে।
ব্যক্তিগত স্বাধীন সম্পত্তির উপর কৃষকের মালিকানাটি সমাজে আবির্ভূত হয়েছে তখন, যখন সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাটি নির্মূল হলো। কিন্তু যে সমস্ত সামাজিক শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে কৃষক তাঁর স্বাধীনতাটি অর্জন করেছিল তার উপর ভর করেই কৃষক তার ব্যক্তিমালিকানা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাটি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।
পুঁজি যখন সুদ অর্জনকারী পুঁজি হিসেবে দেখা দিল তখন থেকেই মুদ্রা দিয়ে মুদ্রা অর্জন করার ভূমিকাটি দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকল। ফলশ্রুতিতে পুরানো সমাজটি পুঁজির করায়ত্তে চলে গিয়ে একটি নতুন সমাজব্যবস্থাতে পরিণত হলো।
ইউরোপীয় মহাদেশে বুর্জোয়া বিপ্লবের ফলে বেশ কয়েক দেশে সামন্ততন্ত্রের পতন হয়। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ককে সামন্ততান্ত্রিক বন্ধনমুক্ত করে তার দ্রুত বিকাশের পথ উন্মুক্ত করা হলো।
কৃষিতে ধনতন্ত্রবাদ এবং উৎপাদিকা শক্তি দ্রুত বিকশিত হয়। এ পথে কৃষিক্ষেত্রে তন্ত্রবাদের বিকাশ ফ্রান্স ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিতে ধনতন্ত্রবাদ বিকাশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
মহান ফরাসি বিপ্লব বড় বড় জমিদারী বিলোপ করে কৃষকদের হাতে জমি তুলে দিয়েছিল। তারপর কৃষিতে ধনতন্ত্রবাদের বিকাশ কৃষকদের মধ্যে বৈষম্যের পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে। অর্থাৎ একদিকে ধনী কৃষকদের সম্মুখে টেনে এনে বৃহৎ ধনতন্ত্রী কৃষকে পরিণত করা হয়েছে আর অপরদিকে গরিব কৃষকের জোত ভেঙে দেয়া হয়েছে।
পুঁজিবাদের উৎপত্তি কখন হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে সামাজিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পুঁজিবাদের ধারণা কৃষিনির্ভর সমাজ থেকেই উদ্ভব হয়েছে বলা চলে এবং এর চরম প্রকাশ ঘটে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে। ভারতে এর বিকাশ লাভ ঘটে সামন্তবাদের পর। কৃষকেরা ক্রমে ক্রমে ব্যবসায় বাণিজ্য প্রসার করে পুঁজিবাদের সৃষ্টি করে।
পুঁজিবাদী সমাজে ‘অর্থ’ই হলো সমস্ত উৎপাদন ব্যবস্থার মূল উৎস। পুঁজিবাদী সমাজে মুনাফার জন্য শ্রমিক-মজুর দ্বারা উৎপাদন ও তাদের হাতিয়ার হিসেবে উৎপাদনের জন্য ব্যবহার এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। লেনিন দেখিয়েছেন যে, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা সর্বত্র একইভাবে বিকাশ লাভ করে নি। একই মৌল কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে তিনটি পর্যায়ে এর স্বরূপ লক্ষ করা যায়; যেমন- বাণিজ্যিক পুঁজিবাদ (Mercantile Capitalism), ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ (Colonial Capitalism) ও অর্থনৈতিক পুঁজিবাদ।
1 comment
[…] আরও পড়ুন: পুঁজিবাদ কি | পুঁজিবাদ বলতে কি বোঝায় | প… […]
Comments are closed.