পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার
বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে যখন পূর্ণ প্রতিযোগিতা বিরাজ করে, তখন তাকে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বলা হয়। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বহুসংখ্যক ক্রেতা-বিক্রেতা একই রকম দ্রব্যসামগ্রীর জন্য দরকষাকষি করে বিশেষ একটি দামে মতৈক্যে আসে। যেকোনো বিক্রেতা ইচ্ছা করলে বাজারে প্রবেশ করতে পারবে বা ইচ্ছা করলে বাজার ত্যাগ করতে পারবে।
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার সম্পর্কে অধ্যাপক পি. এ. স্যামুয়েলসন (P. A. Samuelson) বলেন, “পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোনো কৃষক, ব্যবসায়ী এবং শ্রমিক এতই ক্ষুদ্র অংশ যে, তারা পৃথকভাবে বাজারমূল্যের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।” (Perfect competition exists only is case where no farmer, businessman or labour is a big enough part of the total market to home any personal influence on market price.)
আরও পড়ুন
বাজার কত প্রকার ও কি কি ? |
মিসেস জোয়ান রবিনসন (Mrs. Joan Robinson) বলেন, “যে বাজারে প্রতিটি উৎপাদনকারী ফার্মের উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা পরিপূর্ণ স্থিতিস্থাপক, তাকে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বলে।” (Perfect competition prevails when the demand for the output of each producer is perfectly elastic.)
অর্থাৎ যে বাজারে অসংখ্য ক্রেতা-বিক্রেতা সমজাতীয় পণ্য বাজার নির্ধারিত দামে ক্রয়-বিক্রয়ে লিপ্ত হয় এবং উক্ত বাজারে প্রবেশ ও প্রস্থানে কোনো বাধা থাকে না এরূপ বাজারকে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বলে।
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের বৈশিষ্ট্য
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যেসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা নিচে আলোচনা করা হলো-
১. বহুসংখ্যক বিক্রেতা
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিক্রেতার সংখ্যা বিপুল হতে হবে। এতে প্রত্যেক বিক্রেতা বাজারের মোট যোগানের অতি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে দ্রব্যের দামের ওপর কোনো এক ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
২. বহুসংখ্যক ক্রেতা
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতার সংখ্যাও বিপুল হতে হবে। যাতে সে দ্রব্যের এক ক্ষুদ্র অংশ ক্রয় করে এবং তার ক্রয়ের পরিমাণ দ্রব্যমূল্যের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। যেমন চালের বাজার। গ্রামের কৃষি বাজারে অনেক কৃষক কৃষিজাত দ্রব্য বা চাল সরবরাহ করে এবং অনেক ক্রেতা তা ক্রয় করতে আসে। ফলে সকল বাজারে একটি দ্রব্যের একটি দাম থাকে।
৩. দ্রব্যের সমজাতীয়তা
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দ্রব্য সমজাতীয় না হলে ক্রেতারা তাদের মধ্যে পার্থক্য জ্ঞান করেও একই দামে দ্রব্য ক্রয় করবে না। বিভিন্ন আকৃতির দ্রব্যের জন্য বিভিন্ন চাহিদা হাব। চাল বিভিন্ন প্রকারের হয়। যেমন দেশি চাল ও ইরি চাল। দেশি চালের মধ্যে আবার রূপশাল, নাজিরশাল, বালাম ইত্যাদি সমজাতীয় নয়। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সমজাতীয় দ্রব্য হতে হলে দ্রব্যের রং, আকৃতি, গন্ধ, প্যাকেট, স্বাদ এক হতে হবে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রতম পার্থক্যও থাকতে পারবে না।
৪. উপাদানের পূর্ণ গতিশীলতা
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে উৎপাদনের অবাধ গতিশীলতা রয়েছে। এভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, এক পেশা হতে অন্য পেশায়, এক শিল্প থেকে অন্য শিল্পে শ্রমিক বা পুঁজি যদি সহজে চলাচল করতে পারে, তাকে উপাদানের গতিশীলতা বলে।
৫. প্রবেশের স্বাধীনতা
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যেকোনো বিক্রেতা তার দ্রব্য বিক্রয় করার জন্য যোগান দিতে পারে। অন্য কোনো ব্যক্তি সেই দ্রব্য উৎপাদন করার জন্য নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান করতে চাইলে কোনো বাধার সৃষ্টি হয় না।
৬. দাম ও চাহিদা রেখা
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিক্রেতা বাজার দামকে প্রভাবিত করতে পারে না। তাই দাম রেখা বা চাহিদা রেখা ভূমি অক্ষের সমান্তরাল হয়। এ বাজারে তাই চাহিদা রেখা, গড় আয়, দাম ও প্রান্তিক আয় রেখা একই। অর্থাৎ PAR = MR = D হয়।
চিত্রে দেখা যায়, বাজার নির্ধারিত দাম Po। যেখানে PAR MR D রেখা ভূমি অক্ষের সমান্তরাল হয়।
৭. দাম সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞান
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতাদেরকে বাজারের কোথায় কোথায় তার প্রয়োজনীয় দ্রব্যটি পাওয়া যায় এবং কী দরে দ্রব্যটি বিক্রয় হয় তা ভালো করে জানতে হবে। তাহলে কোনো বিক্রেতা ক্রেতার কাছ থেকে অধিক দাম আদায় করতে পারে না।
৮. যাতায়াত ব্যয় নেই
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের অন্যতম শর্ত হলো যাতায়াতের কোনো ব্যয় নেই। যাতায়াতের ব্যয় থাকলে গতিশীলতা ব্যাহত হয়। ফলে প্রতিযোগিতা কম হয়। যাতায়াত ব্যয় না থাকলে প্রতিযোগিতায় প্রবেশের স্বাধীনতার সুযোগ অনেক ক্রেতা গ্রহণ করতে পারে।
৯. মুনাফা অর্জন
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে একটি ফার্ম বাজারের খুব নগণ্য অংশ যোগান দেয়। তাই সে বাজার দামকে প্রভাবিত করতে পারে না। বরং তাকে বাজার নির্ধারিত দাম মেনে নিতে হয়। এক্ষেত্রে তাকে মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যয় সর্বনিম্নকরণের ওপর গুরুত্ব দিতে হয়।
১০. এক দামে দ্রব্য বিক্রয়
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দ্রব্যের দাম সর্বত্র একই থাকতে হবে। ক্রেতারা দাম সম্বন্ধে যদি পূর্ণ সচেতন থাকে, তবে সর্বত্র সমজাতীয় দ্রব্যের একই দাম থাকবে। এরূপ বাজারে একই দ্রব্যের বিভিন্ন দাম থাকতে পারে না।
১১. ভারসাম্যের শর্ত
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোনো ফার্ম দুটি শর্ত পালনের মাধ্যমে ভারসাম্যে উপনীত হয়।
প্রথম শর্ত: প্রান্তিক ব্যয় MC রেখা প্রান্তিক আয় MR রেখাকে ছেদ করবে। অর্থাৎ ভারসাম্য বিন্দুতে MC=MR হবে।
প্রান্তিক ব্যয় কি? গড় ব্যয় ও প্রান্তিক ব্যয়ের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা কর |
দ্বিতীয় শর্ত: প্রান্তিক ব্যয় (MC) রেখার ঢাল প্রান্তিক আয় (MR) রেখার ঢাল হবে। অর্থাৎ ভারসাম্য বিন্দুতে প্রান্তিক ব্যয় (MC) রেখা প্রান্তিক আয় রেখাকে নিচের দিক থেকে ছেদ করে উপরে উঠবে।
১২. ক্রেতার আচরণ
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতাদের আচরণ অবশ্যই যুক্তিসংগত হতে হবে। ক্রেতারা সবসময় কম দামে দ্রব্য ক্রয় করতে সচেষ্ট হবে।
সুতরাং উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকলে যেকোনো বাজারকে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বলা হয়। এ বৈশিষ্ট্যসমূহের যেকোনো একটির অভাব ঘটলে এরূপ বাজারকে অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার হিসেবে গণ্য করা হয়।