প্রিয় পাঠক, বন্ড কি বা কাকে বলে এবং বন্ড কত প্রকার ও কি কি এগুলো জানা খুব আবশ্যক। কারণ এগুলো বাস্তব জীবনের ক্যাশফ্লো ম্যানেজমেন্টের জন্য আপনাকে অবশ্যই জানতেই হবে। চলুন, এগুলো সম্পর্কে জেনে নিই।
বন্ড কি?
দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের অন্যতম উৎস হলো বন্ড (Bond)। এতে ঋণের পরিমাণ, সুদের হার, পরিশোধের সময়কার এবং আরও শর্তাবলি উল্লেখ থাকে। কর্পোরেশন বা সরকার এরূপ বন্ড ইস্যু করে। অতএব, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রয়োজনে সরকার বা কর্পোরেশন ঋণের পরিমাণ, সুদের হার, পরিশোধকাল এবং অন্যান্য শর্ত সংবলিত যে ঋণের ইস্যু করে তাকে বন্ড বলে।
L. J. Gitman বলেন, যে দলিলের মাধ্যমে কর্পোরেশন সুনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে গ্রহণ এবং ভবিষ্যয়ে সুস্পষ্ট শর্তের মাধ্যমে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়, তাকে কর্পোরেশন বন্ড বলে। অর্থাৎ ‘A corporate bond is a del instrument indicating that a corporation has borrowed a certain amount of money and promise to repay it the future under clearly defined terms.
শেয়ার কত প্রকার ও কি কি? – আলোচনা কর |
Besely and Brigham-এর মতে, ‘A bond is a long term promissory note issued by a business or governmentil unit.’ অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি পত্রকে সরকার বা ব্যবসায়ের একক হিসেবে ইস্যু করা হলে তাকে বন্ড বলে। সাধারণত তিনভাবে বন্ড ইস্যু করা হয়। যথা-
(i) লিখিত মূল্যে (at par);
(ii) প্রিমিয়ামসহ (at premium)
(iii) বাট্টার মাধ্যমে (at discounts)।
বন্ড কত প্রকার ও কি কি?
বন্ড বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যেমন-
ক. জামানতের প্রেক্ষিতে-
১. জামানতবিহীন বন্ড (Unsecured Bond): যে বন্ড বিক্রির সময় ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তারূপে কোনো সম্পত্তিয অন্যকিছু বন্ধক রাখা হয় না, তাকে জামানতবিহীন বন্ড বলে। এক্ষেত্রে বন্ড ক্রেতা কোম্পানির আয়, সুনাম, সুদের হার, ঋণ প্রদান ক্ষমতা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে বন্ড ক্রয় করে। যেমন-আয় বন্ড।
২. জামানতযুক্ত বন্ড (Secured Bond): যে বন্ড বিক্রির সময় ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তারূপে কোনো সুনির্দিষ্ট স্থায় সম্পদ, সম্পত্তি বা অন্যকিছুর দলিল জিম্মাদানকারীর নিকট বন্ধক রাখা হয়, তাকে জামানতযুক্ত বন্ড বলে। যেমন-মর্টগেজ বন্ড।
খ. ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের প্রেক্ষিতে-
১. ট্রেজারি বা সরকারি বন্ড (Govt. Bond): সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত দীর্ঘমেয়াদি বন্ডকে ট্রেজারি বন্ড বলে। এটি দেউলিয়াত্ব ঝুঁকি মুক্ত এবং অন্যান্য বন্ডের তুলনায় ইন্ড কম। যেমন-সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ বছর ব ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করে থাকে।
২. কর্পোরেট বন্ড (Corporate Bond): সাধারণত বৃহৎ কোম্পানি বা কর্পোরেশন কর্তৃক ইস্যুকৃত দীর্ঘমেয়াদি বন্ডকে কর্পোরেট বন্ড বলা হয়। একে সিনিয়র সিকিউরিটিও বলা হয়। এর অর্থ হলো কোম্পানি বিলুপ্ত হলেও অগ্রাধিকার এবং সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের দাবি পরিশোধের পূর্বে এ দাবি পরিশোধ করা আবশ্যক।
৩. মিউনিসিপ্যাল বন্ড (Municipal Bond): সরকারের উন্নয়ন সহযোগী কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ইস্যুকৃত বন্ডকে মিউনিসিপ্যাল বন্ড বলে। এ বন্ডের তারল্যজনিত ঝুঁকি ট্রেজারি বন্ড অপেক্ষা বেশি বলে সুদের হারও ট্রেজারি বন্ড অপেক্ষ বেশি হয়।
৪. বৈদেশিক বন্ড (Foreign Bond): কোনো দেশের সরকার কর্তৃক অন্যকোনো দেশে ইস্যুকৃত বন্ডকে বৈদেশিক বন্ড বলে। এরূপ বন্ডের ঝুঁকি ও সুদের হার উভয়ই বেশি হয়ে থাকে।
গ. পরিশোধের সময়ের উপর ভিত্তি করে-
১. পরিশোধযোগ্য বন্ড (Redemable Bond): যে বন্ড নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি থাকে তাকে পরিশোষযোগ্য বা পরিশোধ্য বন্ড বলে।
২. অপরিশোষযোগ্য বন্ড (Non-redemable Bond): যে ধরনের বন্ডের অর্থ কোম্পানি বিলোপ সাধন না করলে অথবা সময়মতো সুদ প্রদানে ব্যর্থ না হলে কোম্পানি ঐ বন্ডের অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য নয়, তাকে অপরিশোধযোগ্য বন্ড হলে। এ যবাদের বন্ড কোম্পানির অস্তিত্বের সাথে জড়িত।
৩. চিরস্থায়ী বন্ড (Perpetual Bond): এ বন্ডের মূল্য কখনো পরিশোধ করা হয় না। শুধু নির্দিষ্ট সময় অন্তর ৬ (সাধারণত ১ বছর) সুদ প্রদান করা হয়। সরকার বা কোম্পানি চিরন্তন অস্তিত্ব বিধায় এ ধরনের বস্তুও চিরস্থায়ী হয়। এ বন্ডের কখনো অবসায়ন ঘটানো হয় না বলে একে চিরস্থায়ী বন্ড (Consol Bond) বলে।
প্রাথমিক শেয়ার ও মাধ্যমিক শেয়ারের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা |
ঘ. রূপান্তরের উপর ভিত্তি করে-
১. রূপান্তরযোগ্য বন্ড (Convertable Bond): যে ধরনের বন্ড একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে ফেরত দিয়ে এর বিপরীতে শেয়ার প্রদান করে, তাকে রূপান্তরযোগ্য বন্ড বলে।
২. অরূপান্তরযোগ্য বন্ড (Non-Convertable): যে ধরনের বন্ডের বিপরীতে কখনো শেয়ার ইস্যু করা হয় না, মেয়াদ শেষে বন্ডের মূল্য পরিশোধ করা হয়, তাকে অরূপান্তরযোগ্য বন্ড বলে।
ঙ. নিবন্ধনের উপর ভিত্তি করে-
১. নিবন্ধিত বন্ড (Registered Bond): যে ধরনের বন্ডের বিপরীতে কোম্পানি আলাদা রেজিস্ট্রার খাতায় ডিবেঞ্চার হোন্ডারের নাম, ঠিকানা, ক্রমিক নং ইত্যাদি উল্লেখ থাকে এবং হস্তান্তরের সময় রেজিস্ট্রার খাতায় যথানিয়মে তা সংশোধন করতে হয়, তাকে নিবন্ধিত বন্ড বলে।
২. অনিবন্ধিত বন্ড (Unregistered Bond): এ ধরনের বন্ড অনেকটা খোলা বন্ড হিসেবে পরিচিত। এর জন্য ডিবেঞ্চার হোন্ডারের যাবতীয় তথ্য লেখার প্রয়োজন নেই, অর্পণের মাধ্যমেই হস্তান্তরযোগ্য।
চ. অন্যান্য বন্ড (Other Bond)
১. মেয়াদি বন্ড (Definite maturity Bond): এ বন্ডের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। উক্ত মেয়াদ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ঋণগ্রহীতা সুদ প্রদান করেন এবং মেয়াদ শেষে বন্ডের অভিহিত মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে বন্ডের অবসায়ন ঘটানো হয়।
২. আয় বন্ড (Income bond): যে বন্ডের সুদ প্রদান কোম্পানির মুনাফার উপর নির্ভরশীল, তাকে আয় বন্ড বলে। আয় বন্ড এবং অগ্রাধিকার শেয়ারের মধ্যে পার্থক্য হলো, আয় হলেই যে লভ্যাংশ দিতে হবে এরূপ বাধ্যবাধকতা নেই, তবে আয় হলেই সুদ অবশ্যই দিতে হবে।
৩. জিরো কুপন বা কুপনবিহীন বন্ড (Zero Coupon Bond): যে ধরনের বন্ড সমমূল্যে বা কমমূল্যে (বাট্টায়) বিক্রয় করা হয় এবং মেয়াদ শেষে কত টাকা পরিশোধ করে বন্ড ফেরত নেয়া হবে তা উল্লেখ থাকে, তাকে জিরো কুপন বড় বলে। এক্ষেত্রে বন্ডের ক্রয়মূল্য ও পরিশোধ মূল্যের পার্থক্যই হলো ঋণদাতার আয়।
৪. কুপন বন্ড (Coupon Bond): এটি হস্তান্তরযোগ্য এবং এ বন্ডের গায়ে নির্দিষ্ট সুদের হার, পরিপক্ষ সময়, বাহ্যিক মূল্য প্রভৃতি উল্লেখ থাকে; নির্দিষ্ট তারিখে কোম্পানিতে কুপন জমা দিয়ে বন্ড যার নিকট থাকে সেই সুদ উত্তোলন করতে পারে।
৫. জাঙ্ক বন্ড (Junk Bond): উচ্চ ঝুঁকি, উচ্চ প্রতিদানসম্পন্ন বন্ডকে জাঙ্ক বন্ড বলে। ১৯৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ বন্ড প্রচলন হলেও সাম্প্রতিককালে কোনো কোনো দেশে মূলধন বাজার উন্নয়নে এ বন্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ বন্ডের মধ্যে কিছু বন্ড প্রাথমিকভাবে তেমন উচ্চ ঝুঁকি সম্পন্ন হয় না কিন্তু পরবর্তীকালে আর্থিক সমস্যার কারণে উচ্চ ঝুঁকিতে পড়লে তখন উচ্চ বাট্টা প্রদানের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। আবার কিছু বন্ড আছে যেগুলো বিলি করার সময়ই কাউচ্চ ঝুঁকি সম্পন্ন হয়।
এছাড়া, বিলম্বিত সুদযুক্ত বন্ড (Deferred Coupon Bond), পুনঃক্রয় শর্তযুক্ত (Call Provision) বন্ড এবং বিক্রয় শর্তযুক্ত (Put Provision) বন্ড নামেও বিভিন্ন বন্ড রয়েছে। পুট বন্ড হোল্ডারগণ ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে সমমূল্যে বন্ডটি একই ফেরত দিয়ে টাকা ফেরত নেয়ার অধিকার রাখে। আবার ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ মেয়াদ পূর্তির আগেই বন্ড হোল্ডারের কাছ থেকে বন্ডটি ফেরত নিতে পারে। এ ধরনের বন্ডকে ‘কল বন্ড’ বলে।
শেষ কথা
প্রিয় পাঠক, আশাকরি, উপরোক্ত আলোচনা থেকে আপনারা বন্ড কি বা বন্ড কাকে বলে এবং বন্ড কত প্রকার ও কি কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। এবং এর মাধ্যমে আপনি বেশ উপকৃত হয়েছেন বলে আমি মনে করছি। কারণ, এগুলো বাস্তব জীবনে আর্থিক বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য।