বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ সমূহ সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন? তাহলে সঠিক জায়গায় এসেছেন। কারণ, আজকের আলোচনায় বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। সেই সাথে দারিদ্র্য কী বা দারিদ্র্য কাকে বলে সে সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করা হয়েছে। আশাকরি এর মাধ্যমে আপনি যা জানতে চাচ্ছেন তার সবটাই জানতে পারবেন।
দারিদ্র্য কী বা কাকে বলে?
দারিদ্র্য প্রত্যয়টি নেতিবাচক অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝায়। অর্থনীতির দৃষ্টিতে, যে আর্থিক অবস্থা মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ও বাঞ্ছিত জীবনযাপনের অন্তরায় তাকে দরিদ্রতা বলা হয়। অর্থাৎ ‘দারিদ্র্য’ শব্দটি এমন একটি আর্থসামাজিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ যেখানে মানুষ তাদের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ। দারিদ্র্য সম্পর্কে অর্থনীতিবিদদের মতামত জনগণের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেয়; কিন্তু দারিদ্র্যের স্বরূপ ও প্রকৃতি বিস্তৃতভাবে প্রকাশ পায় না।
সমাজবিজ্ঞানী গিলিন (G. L. Gillin) তাঁর ‘Social Pathology’ নামক বইয়ে বলেছেন যে, “যাদের জীবনযাত্রার মান তাদের সমাজ নির্ধারিত জীবনযাত্রার মানের চেয়ে নিচে তারাই গরিব। সেজন্য তারা সমাজজীবনে মানসিক ও দৈহিক নৈপুণ্য প্রমাণ করতে অক্ষম।
সামাজিক সমস্যার কারণ সমূহ জেনে নিন বিস্তারিত |
দারিদ্র্য শব্দটি যেহেতু জীবনমান, খাদ্য ও পোশাক-পরিচ্ছদের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেজন্য এর ধারণা সমাজভেদে ভিন্ন হতে পারে। কারণ ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ, সামাজিক সম্পদ, জনশক্তি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মানুষের জীবনযাত্রাকে বৈচিত্র্যময় করে। ফলে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব মানবজীবনে প্রতিফলিত হয়। যেমন- অনুন্নত এবং উন্নত এ দুই বিভাগ মূলত অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভাগ। এ দুই বিভাগের অন্তর্গত দেশগুলোর আর্থসামাজিক অনগ্রসরতা অনুন্নত দেশগুলোকে এক বিষাক্ত বৃত্তের মাঝে আবদ্ধ করে রেখেছে। এরই প্রেক্ষিতে আমরা দরিদ্রতাকে সাধারণ অবস্থায়, আপেক্ষিক অবস্থায় ও চরম অবস্থায় দেখতে পাই।
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ সমূহ
বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের একটি। এদেশের আপেক্ষিক দরিদ্রের সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগ লোকই সাধারণ দরিদ্রতা ও চরম দরিদ্রতার শিকার। এদেশে দারিদ্র্যের প্রকৃতি খুঁজতে গিয়ে দেশি-বিদেশি অনেক গবেষক মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করেছেন এবং বর্তমানেও দেশি-বিদেশি, সরকারি ও বেসরকারি অনেক সংস্থা এর প্রকৃতি নির্ণয়, কারণ উদ্ঘাটন ও দারিদ্র্য বিমোচনের অর্থনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক জীবনে দরিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। এর প্রভাব ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। আমাদের প্রতিটি সমস্যার সাথেই দরিদ্রতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। আমরা এখানে প্রসঙ্গত বাংলাদেশে যেসব মুখ্য কারণ দারিদ্র্যের জন্য দায়ী তা নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
১. মৌলিক মানবিক চাহিদার অপূরণ
মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের সাথে মানুষের আর্থিক সামর্থ্যের বিষয়টি বিশেষভাবে জড়িত। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের স্বরূপ, প্রকৃতি খুঁজতে গিয়ে অধিকাংশ গবেষকই দারিদ্র্য নির্দেশক হিসেবে মুখ্যত অপূরিত মৌলিক মানবীয় চাহিদার কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজনগুলো সঠিকভাবে ৮০% লোক পূরণ করতে পারে না।
২. কৃষির অনগ্রসরতা
বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ, সম্পদ ও প্রযুক্তির দিক থেকে অত্যন্ত নিম্নগামী। এদেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক গ্রামে বসবাস করলেও এদের শতকরা ৮৫ ভাগ কৃষি পেশায় নিয়োজিত। এদের মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম। তাই সহজে অনুমেয় যে, দারিদ্র্যের কেন্দ্রীয় ভবন গ্রামে। জনসংখ্যার ঘনত্ব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, নিরক্ষরতা, বেকারত্ব এবং রোগগ্রস্ততা গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এসব কারণে মাথাপিছু চাষযোগ্য জমি মাত্র ২৫ শতাংশ, ৫৬.৫০ শতাংশ জনসংখ্যা ভূমিহীন। এছাড়া কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এখনো দুর্বল উৎপাদন উপকরণ নিয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিভিন্ন জনশক্তি কৃষিতে থাকায় আমাদের জাতীয় অর্থনীতি স্থবির হয়ে আছে। আবার কৃষিজাত উৎপাদিত খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য বাজারে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় উৎপাদনে পুঁজিতে ঘাটতি কাটায়ে লাভজনক পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হচ্ছে না।
৩. শিল্পে অনগ্রসরতা
শিল্প ছাড়া কেবল কৃষির মাধ্যমে কোন দেশ দ্রুত উন্নতি লাভ করতে পারে না। বাংলাদেশে শিল্পে অনগ্রসরতার জন্য যেমন দরিদ্রতা টিকে রয়েছে, তেমনি দরিদ্রতার জন্যই শিল্পে অনগ্রসর হয়ে আছে।
৪. ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি
অপরিকল্পিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবারে যেমন ভরণপোষণ ও মৌলিক চাহিদা পূরণে অক্ষমতা বেড়ে যায়; তেমনি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি জাতীয় উৎপাদন ও আয়ের তুলনায় অধিক হওয়াতে ক্রমশ দারিদ্র্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
৫. বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা
জাতীয় উৎপাদনে ঘাটতি থাকায় এবং তা পূরণের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। আবার ঋণ সংগ্রহে ঋণদাতাদের স্বার্থরক্ষা করতে বৈদেশিক ঋণের একটি ব্যাপক অংশ ব্যয় হয়ে যায়। ফলে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি জাতীয় উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
সামাজিক সমস্যা কি | সামাজিক সমস্যা কাকে বলে | সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা |
৬. সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের অভাব
সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের অভাব আমাদের দেশে দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে অসমতা বিরাজ করায় একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে, ব্যাপক জনগোষ্ঠী চরম দারিদ্র্যের মাঝে জীবন অতিবাহিত করছে।
৭. প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটি
বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পর পর কয়েকবার শীর্ষস্থানে। অর্থাৎ প্রথম স্থানে থাকায় দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মুষ্টিমেয় ব্যক্তিত্বের জন্য যে ত্রুটিপূর্ণ আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে তার জন্য দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব হয় নি।
৮. দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি
ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি জনগণের ক্রয় ক্ষমতাকে কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সীমিত আয়ের লোকজন জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। ফলে ক্রমাগতভাবে দরিদ্রতা বেড়েই চলেছে।
৯. কর্মবিমুখ ও ভাগ্যনির্ভরতা
আমাদের দেশের ব্যাপক জনগণ অজ্ঞ ও নিরক্ষরতার জন্য কর্মবিমুখ ও ভাগ্যনির্ভরতায় বিশ্বাসী। নিজের হাতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার উদ্যোগ গ্রহণে অনীহা ও কর্মবিমুখিতা দেখা যায়।
১০. গ্রামীণ বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য
গ্রামীণ বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য হলো ভূমিহীনতা, স্বল্প আয় এবং বেকারত্ব যার ফলশ্রুতি হলো চরম দারিদ্র্য। গ্রামে বসবাসরত পশ্চাৎপদ, ভূমিহীন কৃষক, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক যাদের সম্পদ নেই অথবা থাকলেও তার পরিমাণ যৎসামান্য। এসব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন গ্রামীণ জনগণকে গ্রামীণ দরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
১১. কুটিরশিল্পের বিলুপ্তি
গ্রামীণ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে এক সময় কুটিরশিল্প ছিল আমাদের গৌরব। তৎসঙ্গে অর্থনৈতিক প্রয়োজনের অন্যতম সহায়ক উৎস। বর্তমানে বিদেশের আধুনিক শিল্পকলকারখানার সাথে অসম প্রতিযোগিতায় আমাদের কুটিরশিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এতে কুটিরশিল্পে নিয়োজিত গ্রামীণ শ্রমিকরা অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে, ফলে বেড়ে চলেছে দুর্দশা।
১২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বলা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের জনগণের নিত্যসঙ্গী। নদনদীর ভাঙন, বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়ে যায়। তাতে বহু পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে ঠিকানাবিহীন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে নদনদী ভাঙনের ফলে বহু পরিবার এ দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় পতিত হয়।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। দারিদ্র্যের চরম কষাঘাতে জর্জরিত এদেশের অধিকাংশ মানুষ। উপরিউক্ত কারণে দারিদ্র্যের এ অবস্থা ভয়াবহ রূপ লাভ করে। তাই এটি দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন কার্যকরী উদ্যোগ ও সুস্পষ্ট পদক্ষেপ।