আধুনিক বিশ্বে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে নৃবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেন নৃবিজ্ঞান পাঠ করা প্রয়োজন, নৃবিজ্ঞান পাঠ করলে আমাদের কি কি উপকার হবে ইত্যাদি উল্লেখ পূর্বক নৃবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তুলে ধরা হবে আজকের লেখায়।
নৃবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা
নৃবিজ্ঞান হলো মানুষ ও তার সংস্কৃতি বিষয়ক বিজ্ঞান। এটা জীব হিসেবে মানুষকে এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক জীব হিসেবে তার সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করে। অর্থাৎ যে বিজ্ঞান মানুষের দৈহিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করে তাকেই নৃবিজ্ঞান বলে। এটা মানুষ ও তার সাংস্কৃতির উদ্ভব বিকাশ সম্পর্কে পঠন-পাঠন ও গবেষণা করে।
আরও পড়ুন: নৃবিজ্ঞান কি বা কাকে বলে?
মানুষ ও তার সমাজকে ঘিরে যেসব মৌলিক সমস্যা রয়েছে তা প্রায়ই নৃবিজ্ঞানের কয়েকটি শাখায় আলোচিত হচ্ছে এবং সঠিক সমাধানের ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং মানুষের সামগ্রিক দিক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন ও গবেষণার জন্য নৃবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম এবং এজন্যই আজ সমগ্র বিশ্বে নৃবিজ্ঞান পাঠের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। নিম্নে বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তার বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক সমস্যার সমাধান
বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশ হওয়ায় এর বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। যেমন- জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, খাদ্য ঘাটতি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, যৌতুক সমস্যা, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইত্যাদি। এসব সমস্যার বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানার্জন ঐ সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত জরুরি। ফলিত নৃবিজ্ঞানী আন্তরিকতার সাথে এ ধরনের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে গবেষণা করে সমাধানের পন্থা পদ্ধতির দিকনির্দেশনা দেন।
২. অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণ
আমাদের সনাতনী প্রথার ঐতিহ্যবাহী সমাজে নানা অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি ও কুসংস্কার রয়েছে। জাতির উন্নতি ও অগ্রগতিতে এগুলো নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। অথচ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এগুলো সামাজিকভাবে লালিত হয়ে আসছে। নৃবিজ্ঞানীগণ বিশেষ গবেষণার সাহায্যে জনমতের উপর প্রভাব বিস্তার করে এসব অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে সমাজকে মুক্ত করতে পারেন।
৩. হারানো সূত্র অনুসন্ধান ও বর্ণবাদের অসারতা প্রমাণ
আধুনিক দৈহিক নৃবিজ্ঞানের গবেষণায় দুটি প্রধান সমস্যা হলো : (ক) আধুনিক মানুষের প্রয়োজনে হারানো সূত্রের অনুসন্ধান এবং (খ) বর্ণবাদের ধারাকে অসারতা প্রমাণ করা। দ্বিতীয়টির আংশিক সমাধান মিললেও প্রথমটির কোন সমাধান আজ পর্যন্ত মেলেনি। বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত নরকঙ্কাল সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানী গবেষণা চালাতে পারেন। উপজাতি, হিন্দু-মুসলিম সমাজের বর্ণ প্রথা সম্পর্কেও তার অনুসন্ধান চালাতে পারেন। উদারমনা নৃতাত্ত্বিকগণ এসব সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
৪. অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন
বিভিন্ন সময়ে দেখা যাচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহ নানাবিধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে যে কোন অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত হতে পারে। সুতরাং পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বে এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটা সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির জন্য নৃবিজ্ঞানীগণ যথেষ্ট অবদান রাখতে পারেন।
৫. ভাষাতত্ত্বের সন্ধান
নৃবিজ্ঞানের উপশাখা হলো ভাষাতত্ত্ব। ভাষাতত্ত্বের গবেষণার মাধ্যমে আমরা বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বিকাশ, উচ্চারণ পদ্ধতি ও তুলনামূলক গবেষণা নৃবিজ্ঞান পাঠের মাধ্যমেই জানা সম্ভব। সুতরাং নৃবিজ্ঞান পাঠের ভূমিকা এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য।
৬. অতীত সংস্কৃতির সংরক্ষণ
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে গ্রাম ও শহরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সংস্কৃতির ধারায় পরিবর্তন আসছে। কয়েক যুগ পরে হয়তো বাংলাদেশের অতীত সংস্কৃতি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই অতীত স্বদেশীয় সংস্কৃতিকে সন্ধানের বিষয় হিসেবে নৃবিজ্ঞানীগণ পর্যালোচনা করেন এবং তাদের এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাঙালি তাদের অতীত জাতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভে সক্ষম এবং তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে নবতর ও উন্নতর সংস্কৃতির সন্ধান নিতে পারেন।
৭. নরগোষ্ঠীর ধারণা প্রদান
বাঙালি Race (জাতি বা বংশ) এ নানা Race এর রক্তের সংমিশ্রণ হয়েছে। নৃবিজ্ঞানীগণ তাদের গবেষণা দ্বারা নরগোষ্ঠীগত পরিচয়ের । সূত্র আবিষ্কার করতে পারেন। তাছাড়া নরগোষ্ঠীর উদ্ভব ও বিকাশে যেসব নরগোষ্ঠীর অবদান রয়েছে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা দিতে পারেন।
৮. সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলকরণ
পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের ফলে স্বদেশীয় সংস্কৃতির সাথে তার একটি দ্বন্দ্ব সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে। এটাকে Cultural conflict বলে। উন্নতি ও অগ্রগতির লক্ষ্যে সহায়ক জিনিসকে বর্জনের মাধ্যমে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির ধারা বজায় রাখতে নৃবিজ্ঞানীগণ তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারেন। সামাজিক সংহতি ও বন্ধন দৃঢ় করতে নৃবিজ্ঞানীদের নৃতাত্ত্বিক গবেষণা সহায়ক বলে বিবেচিত হতে পারে।
৯. সংস্কৃতির দিকনির্দেশনার মাধ্যমে উন্নয়নমুখী ধারা প্রবর্তন
উন্নয়নমুখী ধারা 2 প্রবর্তন, সংস্কৃতির বিবর্তন ও পরিবর্তনের ধারণায় বর্তমান বাংলাদেশ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এ গতিধারাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে হলে নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাছাড়া আমাদের দেশে নানা উপজাতির লোক বাস করে। ফলে তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য বিদ্যমান। এ পার্থক্য নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানতে পারি।
১০. চিরায়ত আবহমান বাংলার সন্ধান
বাঙালি সংস্কৃতির আবর্তন, বিবর্তন, নবরূপায়ণ ইত্যাদি পর্যালোচনায় নৃবিজ্ঞান পাঠ বাংলাদেশে অপরিহার্য। আর বাঙালি সংস্কৃতির চির বৈশিষ্ট্য গ্রামকেন্দ্রিক জীবন সম্পর্কে জানা সম্ভব এ নৃবিজ্ঞান পাঠের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন: নৃবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
১১. সমাজ কাঠামো পাঠ
নৃবিজ্ঞানী বিশেষকরে সামাজিক নৃবিজ্ঞানী ক্ষুদ্রাকৃতির সমাজ সম্পর্কে নিবিড় গবেষণা শেষে তথাকার সমাজ কাঠামোর সঠিক চিত্র চিত্রায়ন করতে সক্ষম হন। আর সমাজ কাঠামো সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান কোন সমাজকে অনুধাবন করার জন্য খুবই জরুরি। সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম লক্ষ সমাজের কাঠামো বিশ্লেষণ। এক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞানীর গবেষণা থেকে কোন সমাজবিজ্ঞানী কোন বিশেষ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সমাজের কাঠামো জানতে সক্ষম হন।
১২. শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থা দরিদ্র তথা উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং জীবনমান বৃদ্ধিতে নৃবিজ্ঞানীর গবেষণার ফলকে কাজে লাগান। কেননা নৃবিজ্ঞানী প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে কোন সমাজের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আচার-ব্যবহার ও জীবনমান সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানার্জন করেন যা সমস্যা লাঘবেও কোন পরিকল্পনা কার্যকরী করতে সহায়ক হতে পারে।
এসব আলোচনার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের তথা বাঙালির বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা, সাংস্কৃতিক ক্রিয়া-কলাপ, উপজাতির সমস্যা, বাংলাভাষার লেখার উৎপত্তি, বাঙালি নরগোষ্ঠীর উৎপত্তি ইত্যাদি বিষয়ে জানা সম্ভব।
সুতরাং বাংলাদেশের মানুষ ও তার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হলে প্রত্যেকের নৃবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।