বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণ সমূহ
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো মুদ্রাস্ফীতি। স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। ১৯৬৯-৭০ সালের দ্রব্যমূল্য ১০০ টাকার ভিত্তিতে প্রায় প্রতিটি দ্রব্যের দাম ২৫/৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে এদেশের জনগণের দুঃখ- দুর্দশা অবর্ণনীয়ভাবে বেড়েছে। ২০০৭ সালে দেশে তিনবার বন্যা, প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় “সিডর”-এর আক্রমণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতির হারে ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় বড় মাপের অসাধু ব্যবসায়ীরা ‘সিন্ডিকেট গঠন করে অতি মুনাফার লোভে পণ্যের কৃত্রিম যোগান সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধি করে। ফেব্রুয়ারি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাতীয় পর্যায়ে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ৫.৭২% যা ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে ৫.৪৭%-এ দাঁড়ায়। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট এর সমাধান, খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং বিশ্ব বাজার-এর উপর এটি অনেকাংশে নির্ভরশীল। নিচে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণ সমূহ আলোচনা কর:-
১. অর্থের যোগান বৃদ্ধি
বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো অর্থের যোগান বৃদ্ধি। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর দেশে অর্থের সরবরাহ ছিল ৫৪৬.০২ কোটি টাকা। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে অর্থের যোগানের পরিমাণ দাঁড়ায় ১,৩০২.৪০ কোটি টাকা। মার্চ, ২০১৮ সময়ে এ দেশে অর্থের যোগানের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০,৫৪,১১৩ কোটি টাকা যা বর্তমানে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতির কারণ কি কি – আলোচনা কর |
২. উৎপাদন হ্রাস
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, স্বাধীনতোত্তরকালে উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক দুর্নীতি প্রভৃতি কারণে দেশে দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এর ফলে মোট প্রচলিত অর্থের তুলনায় দ্রব্যসামগ্রীর পরিমাণ কম হওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
৩. জনসংখ্যা বৃদ্ধি
বাংলাদেশে দ্রুত জনসংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে উৎপাদন বাড়েনি। ফলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
৪. উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি
জ্বালানিসহ উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। ফলে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিতে এর অশুভ প্রভাব দেখা দিয়েছে।
৫. খাদ্য সমস্যা
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় খাদ্য ঘাটতি সংঘটিত হচ্ছে। তাই খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যান্য দ্রব্যেরও দাম বৃদ্ধি পায়। সরকারি ও বেসরকারি খাতে প্রতি বছর খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ প্রায় ২৫ লাখ মে. টন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হলে খাদ্য আমদানির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে।
৬. আমদানিজাত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি
বাংলাদেশে আমদানিজাত দ্রব্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে ঐ সকল দ্রব্যের মূল্যস্তর বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি করছে।
৭. উদার ঋণনীতি
বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদার ঋণনীতিও আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া, অপ্রত্যাশিত জরুরি অবস্থা মোকাবেলা, ঘাটতি বাজেট পূরণ, রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় উৎস থেকে ক্রমান্বয়ে অধিক হারে ঋণ গ্রহণ করছে। অনুৎপাদনশীল খাতে অধিক ঋণ গ্রহণের ফলেও মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হচ্ছে।
৮. সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি
সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে প্রতি বছর বৃদ্ধ, এসিডদগ্ধ মহিলা, শারীরিক ও অসচ্ছল প্রতিবন্ধী, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা দুস্থ মহিলা, দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা প্রভৃতি শ্রেণির জনগণকে বিশেষ ভাতা প্রদান করছে। এর ফলে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
৯. আমদানি নিয়ন্ত্রণ
সংরক্ষণমূলক আমদানি নীতির কারণে আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করায় এদেশে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হচ্ছে।
১০. মজুতদার ও চোরাকারবার
মজুতদারি ও চোরা কারবারিগণ সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে হীন স্বার্থে দেশের অভ্যন্তরে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সাময়িক সংকট সৃষ্টি করে। এর ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়।
১১. অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হলো অনুন্নয়ন ও অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি। এটাও মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করছে।
১২. অতিরিক্ত পরোক্ষ কর
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হলো পরোক্ষ করের প্রভাব। দেশের মোট রাজস্বের প্রায় ৮০ ভাগ পরোক্ষ কর হতে আসে। তাই পণ্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
১৩. পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা
বাংলাদেশে পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা মোটেও উন্নত নয়। তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে সঠিক সময়ে দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
১৪. বেতন বৃদ্ধি
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের চাপে আমাদের দেশের শ্রমিকদের বেতন বিভিন্ন সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু উৎপাদন সে অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি। ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৫. রপ্তানি বৃদ্ধি
সাম্প্রতিক সময়ে এদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যের যোগান হ্রাস পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
১৬. প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায় লেগেই থাকে। ফলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করছে।
১৭. দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরিবেশ বজায় থাকায় বাংলাদেশে দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন ব্যাহত হয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করছে।
১৮. অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ
চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রত্যাশিত পর্যায়ে না পৌঁছানো, ঘন ঘন লোডশেডিং-এর ফলে উৎপাদন, ব্যবসায়-বাণিজ্যে চরম সংকট চলছে। এতে যোগান সংকট তৈরি হয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করছে।
১৯. অস্থিতিশীল রাজনীতি
স্বাধীনতার চার দশকের শেষ পর্যায়ে এসেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন স্থিতিশীল নয় বললে ভুল হবে না। এর ফলে সমাজে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিপন্থী উপাদান সক্রিয় থাকায় মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
২০. সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব ও উন্নয়ন ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে বাজারে অর্থের যোগান অনেক বেড়ে গিয়েছে। সে তুলনায় দ্রব্যের যোগান বা উৎপাদন বাড়েনি, ফলে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হচ্ছে।
শেয়ার ও বন্ডের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর |
২১. ট্রেড ইউনিয়ন
বাংলাদেশে যেকোনো কল-কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন বেশ শক্তিশালী। সর্বশেষ প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টস শিল্পেও এটি কার্যকর হয়েছে। তারা নানা অজুহাতে বেতন বৃদ্ধির দাবি তোলে উৎপাদনকার্যে অস্থিরতা- অনিশ্চয়তা তৈরি করে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বাধ্য হয়ে মালিক পক্ষ বেতন বৃদ্ধি করে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়, তখন দামস্তরও বাড়ে।
২২. সিন্ডিকেট বাণিজ্য
ব্যবসায়-বাণিজ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গঠন করে দ্রব্য-সামগ্রীর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। বাজারে দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে অতি মুনাফা লুটে নেয়, ফলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
২৩. বাজার ব্যবস্থা তদারকির অভাব
বাজার ব্যবস্থার উপর সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা- কর্মচারীদের পর্যাপ্ত মনিটরিং বা বাজার তদারকির যথেষ্ট অভাব রয়েছে অথবা কর্মকর্তা দুর্নীতিবাজ। ফলে দ্রব্য-মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়।
২৪. জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি খাত যৌথভাবে বা স্ব- উদ্যোগে অনেক অবদান রাখছে। উৎপাদন আশানুরূপ না বাড়লেও মানুষের আয় ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে দ্রব্য-মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায়, বর্তমানেও বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির চাপ বিদ্যমান রয়েছে। তবে সরকারের সতর্ক মুদ্রানীতি ও নিয়ন্ত্রিত ঋণ সরবরাহ নীতির ফলে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিম্ন পর্যায়ে সীমিত রাখার চেষ্টা চলছে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হলে এবং সরকারের নিরাপদ খাদ্য মজুদনীতি বিদ্যমান থাকলে মুদ্রাস্ফীতির তীব্রতা হ্রাস পাবে। তবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশে মুদ্রাস্ফীতি একেবারেই কমানো যাবে না।
আশাকরি, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণ সমূহ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পেরেছেন। মুদ্রাস্ফীতি একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেই কাম্য নয়। তাই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।