বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা – মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এবং মানুষের পারস্পরিক সম্বন্ধহেতু মানবজীবনে তথা সমাজে যা কিছু ঘটে, এর সামগ্রিক আলোচনা সমাজবিজ্ঞানের অন্ত র্ভুক্ত। সমাজের প্রকৃতি এবং সমাজজীবনের বৃহত্তর দিক তথা পরিবার, রাজ্য, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, অর্থনৈতিক অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির ও গির্জার মধ্যে কিভাবে সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত ও বিকশিত হয়ে উঠে সমাজবিজ্ঞান তা আলোচনা করে থাকে। কাজেই সমাজজীবনের আলোচনায় মানুষের উদ্দেশ্য, আদর্শ, আশা-আকাঙ্ক্ষার আলোচনা অবাস্তব নয়। সমাজের জন্য এবং সমাজের উন্নতিকল্পে সামাজিক মানুষের সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অত্যধিক। যে কোন সমাজেই সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে অনুন্নত দেশে সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করা যায়। আমাদের দেশে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান প্রতিটি মানুষের থাকা একান্ত প্রয়োজন। সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান মানে সামাজিক ধারণার সম্প্রসারণ। আপন সমাজ ও ব্যক্তি চরিত্রের আলোকসম্পাত করতে হলে সমাজবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আমাদের সমাজকে উন্নত করতে হলে, জীবনের মূল্যবোধকে ব্যক্তিচরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হলে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। আমরা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছি, জীবনের মূল্যবোধকে সজাগ দৃষ্টিতে দেখছি; কিন্তু এসব কেন হচ্ছে তার উত্তর খুঁজে বের না করলে কোনদিনও আমাদের উন্নতির পথ প্রশস্ত হবে না।
বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান সমূহ; যেমন- রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান ও লোকপ্রশাসন অধ্যয়ন করা হচ্ছে। এগুলো সামাজিক জীবনের এক একটি দিক নিয়ে আলোচনা করে। আমাদের জীবনে বা সমাজব্যবস্থায় যে পরিবর্তন তা কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন নয়; অর্থনৈতিক মানের পরিবর্ধনও নয়। এ পরিবর্তন গোটা সমাজকাঠামোর পরিবর্তন।
গোটা সমাজকাঠামোর ঐতিহ্য থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের প্রচেষ্টাই আমাদের পরিবর্তনের লক্ষ্য। সমাজকাঠামোর এহেন সার্বিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের ভূমিকা সারা সমাজ জুড়ে বিস্তৃত। সমাজের সামগ্রিক কাঠামোর রূপ সমাজবিজ্ঞান ব্যতীত অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান আলোচনা করে না। এসব বিজ্ঞান এক একটি খণ্ডিত ও অপূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান। কাজেই বাংলাদেশের সমাজ তাদের সামাজিক কাঠামো, শ্রেণীবিন্যাস, সমস্যা, ভাষা, মানুষ ও তাদের আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, তাদের বিশ্বাস ও প্রথা, তার অর্থনৈতিক, সামাজিক মান ও জীবনযাত্রা প্রভৃতি জানতে হলে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান অপরিহার্য। কারণ এসব বিষয় নিয়ে সমাজবিজ্ঞান সমাজকে পূর্ণাঙ্গভাবে অধ্যয়ন করে।
তাছাড়া আমাদের সমাজে ধর্মীয় প্রভাব, সংস্কৃতি, ভাষা, পরিবেশ, শহরের পরিবেশ ও জীবনযাত্রা এবং সাম্প্রতিক পরিবর্তনের গতিধারা প্রভৃতি সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। এসব বিষয়কে জানতে হলে পাশ্চাত্যের সমাজবিজ্ঞান গ্রন্থের উপর নির্ভর করলে চলবে না। কারণ তাদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও সামাজিক কাঠামো এবং আমাদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও সামাজিক কাঠামোর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। অবশ্য তাদের পণ্ডিতদের লেখা থেকে আমরা অনেক মূল্যবান উপকরণ পেতে পারি যা বাংলাদেশের সমাজ বিশ্লেষণে সহায়ক এবং বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান বিকাশে অবদান হিসেবে কাজ করবে।
আজ বাংলাদেশ নানাবিধ সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন। আমরা সাধারণত বলে থাকি অর্থনৈতিক সমস্যাই সামাজিক সমস্যার মূল কারণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সামাজিক সমস্যার মূলে নিহিত রয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যা। একথা বলা অন্যায় হবে না যে, আমাদের সমাজব্যবস্থায় আজ দারুণ অস্থিরতা বিরাজমান। এ অস্থিরতা গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে নগরভিত্তিক শিল্প অর্থনীতিতে পরিবর্তনের অস্থিরতা বর্তমানকে ভেঙেচুরে নতুন ছাঁচে গড়ে তোলার প্রবণতা। পাশ্চাত্যের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাবে কৃষি অর্থনীতির মৃত্তিকা থেকে উৎসারিত আমাদের ট্রেডিশনাল জীবনধারা আজ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। উন্নত টেকনোলজির জন্য যে ধরনের সামাজিক প্রস্তুতি ও মানসিকতার দরকার, সেক্ষেত্রে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এখনো আসেনি। পরিণামে সাংস্কৃতিক ও মানসিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্য, হতাশা ও অবসাদ দেখা দিয়েছে। এসব উদ্ভূত সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে আমাদের সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন । কেননা সমাজবিজ্ঞান এসব বিষয়ের প্রতিও আলোকপাত করে।
তাছাড়া আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আমাদের সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার; ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সম্পর্কে বাস্তব ও নিরপেক্ষ গবেষণা। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থাকে জানতে হলে বাঙালি সমাজবিজ্ঞানীর প্রয়োজন। তাহলেই আমরা সুষ্ঠু সমাজ গড়ে তোলার সুযোগ পাব।
আমরা বর্তমানে যেসব উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করছি, সেই সাথে সামাজিক জ্ঞান না থাকলে সমাজে এসবের বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ নতুন পরিকল্পনার সাথে সাথে সমাজব্যবস্থায় যেসব নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি হবে এবং পুরাতন মূল্যবোধের সাথে সেগুলোর যে বিরোধ বাধার সম্ভাবনা থাকবে তা দূরীকরণে সমাজবিজ্ঞানই সুষ্ঠু জ্ঞান দিতে পারবে।
কাজেই আমাদের দেশে সমাজবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার আরো একটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, আমাদের দেশের নানা অংশে বিভিন্ন উপজাতি রয়েছে। এদের জীবনযাত্রা প্রণালী এখনো সেই আদিম প্রকৃতির। এদের জীবনধারায় পরিবর্তন আনয়ন করতে হলে সমাজবিজ্ঞান সম্বন্ধে জ্ঞানের প্রয়োজন। সুতরাং বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যান্য লেখা
সমাজবিজ্ঞানের সাথে সমাজকর্মের সম্পর্ক
সমাজবিজ্ঞানের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক
সমাজবিজ্ঞানের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক
সমাজবিজ্ঞানের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক
সমাজবিজ্ঞানের সাথে নৃবিজ্ঞানের সম্পর্ক