বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ সমূহ
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই একটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রয়েছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’। স্বাভাবিক কারণেই এ ব্যাংকের দায়িত্ব ব্যাপক, কার্যাবলিও বিস্তৃত। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর দেশের আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দায়িত্ব রয়েছে। এ ব্যাংক যত দক্ষতা ও সফলতার সাথে আর্থিক ব্যবস্থা পরিচালনা করতে পারবে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত নিশ্চিত হবে। নিচে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ সমূহ তুলে ধরা হলো-
১. নোট প্রচলন
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো নোট প্রচলন করা। নোট প্রচলনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণত ন্যূনতম রিজার্ভ পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংককে মোট কাগজি নোট ইস্যু করার বিপরীতে কমপক্ষে ৬০ কোটি টাকা সমমূল্যের স্বর্ণ, রৌপ্য ও অনুমোদিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকের ইস্যু বিভাগে জমা রাখতে হয়। ব্যাংকের অন্যান্য সম্পদ এবং অনুমোদিত বাণিজ্যিক ঋণপত্রের আকারে রাখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে ৫ টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা ও ১,০০০ টাকা মূল্যের নোট প্রচলন করেছে। বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্বাধীনে ১ টাকা ও ২ টাকা মূল্যের নোট প্রচলন রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের পক্ষে প্রচলিত ০.২৫ টাকা, ০.৫০ টাকা, ১ টাকা, ২ টাকা ও ৫ টাকা মূল্যের ধাতব মুদ্রা প্রচলন করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আলোচনা কর |
২. সরকারের ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের ব্যাংক হিসেবে কাজ করে। সরকারের সকল মুদ্রা এ ব্যাংকে জমা থাকে। অবশ্য তার জন্য কোনো সুদ প্রদান করা হয় না। এ ব্যাংকের মাধ্যমেই সরকারের যাবতীয় লেনদেন সম্পাদিত হয়। অনেক সময় সরকার এ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকে। সাধারণত অনধিক ৯০ দিনের জন্য এ ঋণ দেওয়া হয়। প্রয়োজনের সময় এ ব্যাংক সরকারকে আর্থিক বিষয়ে পরামর্শ দেয়।
৩. অন্যান্য ব্যাংকের ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অন্যান্য ব্যাংকসমূহের ব্যাংক হিসেবে তাদের ওপর কর্তৃত্ব করে। তফসিলভুক্ত প্রতিটি ব্যাংকের চলতি ও স্থায়ী আমানতের শতকরা ৫ ভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। এর ফলে অন্যান্য ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় হয়। মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন সহজতর ও কার্যকর হয়।
৪. ঋণের শেষ আশ্রয়স্থল
অন্য কোথাও ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়ে গেলে ঋণের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে অন্যান্য ব্যাংকসমূহ বাংলাদেশ ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়। আমানতকারীরা হঠাৎ ব্যাংক থেকে তাদের নগদ টাকা উঠিয়ে নিলে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ অসুবিধার মুখোমুখি হয়। এ রকম আর্থিক অনটনের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত আমানত জমা রেখে অথবা অঙ্গীকারপত্র বা হুন্ডি ভাঙিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংককে নগদ টাকার ব্যবস্থা করে দেয়। ফলে উক্ত ব্যাংক নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে নিষ্কৃতি পায়।
৫. ঋণ নিয়ন্ত্রণ
বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ নিয়ন্ত্রণ হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। কারণ বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ মুদ্রার যোগান বাড়িয়ে দেয়। ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংককে মুদ্রার যোগান হ্রাস করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। আবার ব্যাংকসমূহ প্রয়োজনের তুলনায় কম ঋণ সরবরাহ করলে দেশে মুদ্রা সংকোচন দেখা দেয়। তখন বাধ্য হয়েই বাংলাদেশ ব্যাংককে ঋণের যোগান বাড়ানোর ব্যবস্থা করে। ঋণের যোগান বাড়ানো বা কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
৬. বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম দায়িত্ব হলো দেশীয় মুদ্রার বৈদেশিক বিনিময় হার নির্ধারণ ও স্থিতিশীল রাখা। বাংলাদেশের অর্জিত সকল বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সকল প্রকার লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়। তাছাড়া এ ব্যাংক সরকারের পক্ষ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় করে।
৭. নিকাশঘর
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অন্যান্য ব্যাংকসমূহের নিকাশঘর হিসেবে কাজ করে। বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের মধ্যে চেকের মাধ্যমে লেনদেনের ফলে পারস্পরিক দেনা-পাওনার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক নিকাশঘর হিসেবে লেনদেন মিটিয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখে।
৮. উন্নয়নমূলক কাজ
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য কৃষি ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক, সমবায় ব্যাংক, শিল্প ঋণ সংস্থা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করে।
৯. মুদ্রার মান সংরক্ষণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম কাজ হলো বৈদেশিক বিনিময় মান রক্ষা করা। দেশের কাগজি নোট এবং ধাতব মুদ্রার সাথে বৈদেশিক মুদ্রার মান সংরক্ষণ বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। এ ব্যবস্থা দ্বারা বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের মূল্যস্তরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে।
১০. সুষ্ঠু ব্যাংকিং ব্যবস্থা
বাংলাদেশ ব্যাংক সুষ্ঠু ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে দক্ষ ব্যাংক ব্যবসায়ী সৃষ্টির দায়িত্ব পালন করে। একটি ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাকে বলে | কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ কি |
১১. গবেষণা
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে। গবেষণার ফলাফল বিভিন্ন জার্নাল, সাময়িকীতে প্রকাশ করে দেশের সরকার ও জনগণকে সাহায্য করে।
১২. অন্যান্য কাজ
বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের কাজ পরিচালনা করে। যেমন দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, দেশ-বিদেশে ব্যাংকের শাখা খোলা, সমবায় ঋণদান, বিভিন্ন প্রকার শেয়ার ও সিকিউরিটি ক্রয়- বিক্রয়, সহজ বিনিময় মাধ্যম সৃষ্টি, তফসিলি ব্যাংকের তদারক, সহজ ঋণদান ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করা, অন্যান্য ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যাবলি তদারকি করা, উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদনে সরকারকে আর্থিক বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া, ব্যাংক কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশ করা ইত্যাদি।
সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং কার্যক্রম, আর্থিক নীতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রভৃতি কাজে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য ও সহযোগিতাদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান।