মিশ্র অর্থব্যবস্থা কি বা কাকে বলে?
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়। মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকারি এবং বেসরকারি মালিকানা পাশাপাশি বিরাজ করে। এজাতীয় অর্থব্যবস্থায় একদিকে যেমন বেসরকারি উদ্যোগে শিল্প এবং ব্যবসায় পরিচালিত হয়, অন্যদিকে সরকারও উদ্যোক্তার ভূমিকা গ্রহণ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও উদ্যোগ এবং বেসরকারি স্বাধীনতা ও উদ্যোগ পাশাপাশি বিরাজ করে, তাকে মিশ্র অর্থব্যবস্থা বলা হয়। অর্থাৎ এ অর্থব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের উপস্থিতি স্বীকৃত।
অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েলসন (Samuelson) বলেন, “মিশ্র অর্থনীতি বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে উৎপাদন ও ভোগকর্ম সংঘটিত করার ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থার সাথে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংমিশ্রণ ঘটেছে।” (A mixed economy is one in which the elements of government control are intermingled with market elements in organizing production and consumption.)
ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য |
অধ্যাপক জে. এফ. র্যাগান (J. F. Ragan) ও এল. বি. থমাস (L. B. Thomas) বলেন, “মিশ্র অর্থনীতি হলো এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে বিশুদ্ধ ধনতন্ত্র ও নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সংমিশ্রণ ঘটে। কিছু সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় এবং কিছু সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকে। এছাড়া অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত কিছু বাজার ব্যবস্থায় এবং কিছু কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে।”
মিশ্র অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সমূহ
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় একদিকে বেসরকারি উদ্যোগে শিল্প, ব্যবসায় পরিচালিত হয়। অন্যদিকে, সরকারও উদ্যোক্তার ভূমিকা গ্রহণ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে। মিশ্র অর্থব্যবস্থায় নিম্নবর্ণিত বৈশিষ্ট্যসমূহ পরিলক্ষিত হয়-
১. সরকারি বিনিয়োগ
মিশ্র অর্থব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সরকারি বিনিয়োগ। জাতীয় নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে এমন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকারখানা ও ব্যবসায় মূলধন বিনিয়োগ করে। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
২. বেসরকারি বিনিয়োগ
মিশ্র ব্যবস্থায় সরকার অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের উচ্চসীমা নির্ধারণ করে দেয়। মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় বেসরকারি বিনিয়োগ করা হয়। তবে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ও শিল্পকারখানার ওপর সরকারের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে।
৩. সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে সহাবস্থান
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রের সহাবস্থান লক্ষ করা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালানো হয়। এদের মাঝে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে পরিপূরক সম্পর্ক থাকে।
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা কাকে বলে | ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সমূহ |
৪. সম্পত্তির মালিকানা
মিশ্র অর্থব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সম্পত্তির মালিকানা ভোগ করা। এ অর্থব্যবস্থায় সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে কৃষি জমি, শহরের জমি প্রভৃতির ক্ষেত্রে সম্পত্তির ঊর্ধ্বতন সীমা নির্ধারণ করে মালিকানা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
৫. উদ্যোক্তার ভূমিকা
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় উদ্যোক্তার স্বাধীনতা থাকে। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ব্যবসায় বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে অধিক স্বাধীনতা স্বীকৃত। তবে সরকার প্রয়োজনে আইন পাস করে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
৬. দামব্যবস্থা কার্যকর
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় দামব্যবস্থা কার্যকর হয়ে থাকে। তবে দামব্যবস্থার ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। বিশেষ করে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেলে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
৭. স্বয়ংক্রিয় দামব্যবস্থা
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগ- এসব কর্ম স্বয়ংক্রিয় দামব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাজারে চাহিদা ও যোগান দ্বারা দাম নির্ধারিত হয়।
৮. মুনাফার উপস্থিতি
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে কাজকর্ম সম্পাদিত হয়। বেসরকারি উদ্যোগে মুনাফার উপস্থিতি থাকে। তবে সরকারি উদ্যোগে জনসাধারণের কল্যাণে দাম ও মুনাফা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
৯. মুদ্রাস্ফীতির উপস্থিতি
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তির উদ্যোগ স্বীকৃত। এ ব্যবস্থায় মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধিতে সরকার বাধা দেয় না। এক্ষেত্রে অনেক সময় অতি উৎপাদন এবং অনেক সময় কম উৎপাদন সমস্যার সৃষ্টি করে। ফলে মিশ্র অর্থব্যবস্থায় মুদ্রাস্ফীতির উপস্থিতি থাকে।
১০. অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করে। মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রা সংকোচন রোধ করেও সরকার কালোবাজারি, মজুদদারি, বাণিজ্যচক্র মোকাবিলা করে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা কাকে বলে | সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য |
১১. শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা হয়। সরকার শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, কাজের সময় নির্ধারণ, শ্রমিক-মালিক বিরোধের নিষ্পত্তি ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
১২. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকার অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কাজকর্মে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। কৃষি, শিল্প, ব্যবসায় বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার তা কার্যকর করতে চেষ্টা করে।
মিশ্র অর্থব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সংমিশ্রণ। এ অর্থব্যবস্থায় ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা উভয়েরই কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। মিশ্র অর্থব্যবস্থা হলো ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানকারী একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
1 comment
[…] মিশ্র অর্থব্যবস্থা কি বা কাকে বলে? মিশ… […]
Comments are closed.