প্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ, আজকে আমরা আলোচনা করবো মুদ্রা কি বা মুদ্রা কাকে বলে এবং আধুনিক অর্থনীতিতে অর্থের গুরুত্ব সম্পর্কে। এগুলো বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রায়ই এসে থাকে। এই ব্লগটি পড়লে আপনারা পরীক্ষায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারবেন।
মুদ্রা কি বা কাকে বলে?
মুদ্রা নিজে মুদ্রা নয়। “মুদ্রা যা করে থাকে তা মুদ্রা।” (Money is what money does.) এখানে ‘মুদ্রা যা করে থাকে’ বলতে আমরা বুঝি, মুদ্রা মানুষের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু পাওয়ায় সাহায্য করে। অর্থাৎ মুদ্রা একটি বস্তু যার বিনিময়যোগ্যতা ও ক্রয়ক্ষমতা আছে, যার পরিবর্তে মানুষ আকাঙ্ক্ষিত দ্রব্য সহজে পায়। একটি ১০ টাকার নোট যদি চিরকালের জন্য বইয়ের মধ্যে বা মাটির নিচে রেখে দেওয়া হয়, তবে তাকে মুদ্রা বলা যাবে না। যখন এর বিনিময়ে কোনোকিছু ক্রয় করা হয়, তখনই তা প্রকৃতপক্ষে মুদ্রা হয়।
সাধারণভাবে বলা যায়, মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যম। মুদ্রা এমন একটি বিনিময়ের মাধ্যম যা সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং যার দ্বারা ক্রয়-বিক্রয় ও সকল প্রকার লেনদেন তথা দেনা-পাওনার হিসাব সম্পন্ন করা যায়।
সরকারি ব্যয় কি | সরকারি ব্যয়ের খাতসমূহ আলোচনা কর |
বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বিভিন্নভাবে মুদ্রা সংজ্ঞায়িত করেছেন। অর্থনীতিবিদ জি. ডি. এইচ, কোল (G. D. H. Cole) বলেন, “মুদ্রা এমন একটি জিনিস যা দেনা-পাওনা মেটাতে রীতি অনুযায়ী ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত এবং ঋণ পরিশোধে সাধারণভাবে গৃহীত হয়।”
অর্থনীতিবিদ ওয়াকার ( Walker)-এর মতে, অর্থ যা করে তাই অর্থ। (Money is what money does) অর্থনীতিবিদ জি. ক্রাউথার (G. Crowther) বলেন, “মুদ্রা তাই যা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সকলের নিকট গ্রহণীয় এবং যা মূল্যের পরিমাপক ও সঞ্চয়ের বাহন হিসেবে কাজ করে।”
অর্থনীতিবিদ ডি. এইচ, রবার্টসন (D. H. Robertson) বলেন, “দ্রব্যের মূল্য পরিশোধ অথবা অন্য কোনো কার্যকলাপ করতে গিয়ে যা গ্রহণযোগ্য হয় তাই মুদ্রা।” জার্মানির অর্থনীতিবিদ ন্যাপ-এর মতে, “যে বস্তু ঋণ পরিশোধের জন্য আইনত গ্রহণযোগ্য তাকেই মুদ্রা বলা যায়।”
অর্থনীতিবিদ আর. পি. কান্ট বলেন, “মুদ্রা এমন একটি জিনিস যা বিনিময়ের মাধ্যম বা মূল্যের মান হিসেবে সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়।” মুদ্রার সংজ্ঞাসমূহ বিশ্লেষণ করলে যেসব বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় তা হলো- ১. মুদ্রা সর্বজনগ্রাহ্য, ২. মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যম, ৩. মুদ্রা মূল্যের পরিমাপক ও ৪. মুদ্রা সঞ্চয়ের বাহন।
সুতরাং যা কিছু সকল প্রকার অর্থনৈতিক বিনিময়ের মধ্যে সর্বজনগ্রাহ্য এবং ঋণদাতা ঋণ পরিশোধ হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য, অর্থনীতিতে তাকে মুদ্রা বলা হয়। মুদ্রা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- বাংলাদেশে টাকা, জাপানে ইয়েন, জার্মানিতে মার্ক, ইংল্যান্ডে পাউন্ড, রাশিয়ায় রুবল, আমেরিকায় ডলার ইত্যাদি।
আপনার পড়ছেন, মুদ্রা কি বা কাকে বলে ও আধুনিক অর্থনীতিতে অর্থের গুরুত্ব সম্পর্কে।
আধুনিক অর্থনীতিতে অর্থের গুরুত্ব। Importance of Money in Modern Economics আধুনিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অর্থ প্রধান চালিকাশক্তি রূপে কাজ করে এবং তা কর্মক্ষম ও গতিশীল রাখে। এজন্যই আধুনিক অর্থনীতিকে ‘মুদ্রা অর্থনীতি’ বলা হয়। নিচে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক অর্থনীতিতে অর্থের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-
১. বিনিময় ব্যবস্থার সহজ ও সরলীকরণ: মুদ্রা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে দ্রব্যের বিনিময় অত্যন্ত সহজ ও সরল
হয়েছে। মানুষ মুদ্রার মাধ্যমে দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। দ্রব্যের সামঞ্জস্যের অভাব এখন বিনিময়কে দুঃসাধ্য করতে পারে না।
২. মূল্যের পরিমাপক: মূল্যের পরিমাপক হিসেবে দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থা একটি বিশেষ অসুবিধা দূর করেছে। পূর্বে কোন দ্রব্যের সাথে কোন দ্রব্যের কত পরিমাণ বিনিময় হবে তার কোনো নির্দিষ্টতা ছিল না। মুদ্রার ব্যবহার দ্বারা আমরা সহজেই সকল দ্রব্যের মূল্য প্রকাশ করতে পারি।
৩. ঋণের ভিত্তি: বর্তমান যুগে ঋণের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঋণের মাধ্যমে যথেষ্ট অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সাধিত হয়। ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা মুদ্রার মাধ্যমে সহজেই লেনদেন করে ব্যবসায় বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করতে পারে। ঋণের পরিমাণ মুদ্রার মাধ্যমেই নির্ধারণ করা হয়।
৪. সঞ্চয়ের বাহন: সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে মুদ্রার ব্যবহার অর্থনীতিতে এক বিরাট পরিবর্তন আনয়ন করেছে। দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থায় মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চয় করা যায় বলে মানুষ তার বর্তমান আয় হতে সঞ্চয় করতে পারে এবং এ সঞ্চিত মুদ্রা দ্বারা দেশে মূলধন গঠন করা সম্ভব হয়।
৫. উৎপাদনের সুবিধা: উৎপাদন ক্ষেত্রে মুদ্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যুগে শ্রমবিভাগ ও বিশেষীকরণের বিশেষ প্রয়োজন। মুদ্রার ব্যবহার দ্বারা শ্রমবিভাগ, বিশেষীকরণ ও জটিল উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। বৃহদায়তন উৎপাদন ক্ষেত্রে উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রয় হওয়ার পূর্বেই উৎপাদনের উপাদানসমূহকে মুদ্রা দ্বারা তাদের পাওনা পরিশোধ করা হয়। ৬. বণ্টনের সুবিধা: বণ্টনের ক্ষেত্রে মুদ্রার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উৎপাদনের মোট আয় মুদ্রা দ্বারাই নির্ধারণ বা
প্রকাশ করা হয়। উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণ করা উপাদানসমূহের পাওনা মুদ্রা দ্বারা সহজেই বণ্টন করা যায়। ৭. ভোগের সুবিধা: ভোগের ক্ষেত্রে মুদ্রার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মুদ্রার মাধ্যমে মানুষ তার সম্পদ বিভিন্নভাবে ব্যবহার
করতে পারে এবং সুবিধামতো ভোগ করতে পারে। মুদ্রার পূর্ণ ব্যবহার দ্বারা মানুষ সর্বাধিক তৃপ্তি লাভের চেষ্টা করে। ৮. স্থানান্তরের সুবিধা: আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ মুদ্রা স্থানান্তরের সুবিধার কথা বলেছেন। কারণ মুদ্রা থাকলে যেকোনো দ্রব্য ক্রয় করা যায়। মুদ্রা সহজে পরিবহণযোগ্য। দেশ-বিদেশের যেকোনো স্থানে মুদ্রা গ্রহণযোগ্য।
জাতীয় আয় পরিমাপের সমস্যা সমূহ আলোচনা কর |
৯. ব্যবসায় বাণিজ্যের সুবিধা ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যবসায় বাণিজ্যে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রা ব্যবহৃত হওয়ায় মুদ্রার মাধ্যমে ঋণের লেনদেন করা হয়। মুদ্রার মূল্য অপেক্ষাকৃত কম পরিবর্তনশীল। কাজেই মুদ্রার মাধ্যমে ব্যবসায়িক লেনদেন পরিশোধ করা খুবই সহজ ও নিরাপদ বলে আজকাল দেশে-বিদেশে মুদ্রার গুরুত্ব বেশি।
১০. অর্থনৈতিক কার্যাবলি: রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কার্যাবলি পরিচালনায় মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারি
আয়-ব্যয়ের সমুদয় হিসাব-নিকাশ মুদ্রার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। কোন খাত থেকে কত আয় হয় এবং
কোন খাতে কী পরিমাণ ব্যয় করা হয়, সরকার মুদ্রার মাধ্যমে তা পরিচালনা করে। সুতরাং বলা যায়, রাষ্ট্রীয়
অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মূল চাবিকাঠি হলো মুদ্রা। ১১. সামাজিক গুরুত্ব: সামাজিক ক্ষেত্রে মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ সমাজে মানুষের অবস্থান, সামাজিক মর্যাদা, প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠা এমনকি দান-উপহার মুদ্রার মানদণ্ডে বিচার করা হয়। কাজেই আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার প্রধান বাহন হলো মুদ্রা।
১২. রাজনৈতিক গুরুত্ব: মুদ্রার রাজনৈতিক গুরুত্ব কম নয়। দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন ও উন্নয়ন নীতিনির্ধারণে মুদ্রার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিভিন্ন দেশের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক আর্থিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে।
১৩. পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা: পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিগত উদ্যোগ, অবাধ ব্যবসায় বাণিজ্য, বণ্টন, ভোগ, দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া প্রতিক্ষেত্রেই মুদ্রা প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
১৪. সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ অর্থব্যবস্থায় দেশের জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং প্রতিরক্ষার ব্যাপারে মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বর্তমান বিশ্বে উৎপাদন ব্যবস্থা, ভোগ, বিনিময়, সঞ্চয়, বণ্টন প্রভৃতি ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়ন অর্থব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলেই সম্ভব হয়েছে। অর্থনীতিবিদ জি. ক্রাউথার (G. Crowther) যথার্থই বলেছেন, “অর্থনীতিতে মুদ্রা মানুষের সমাজ জীবনের ব্যবসায় বাণিজ্যসংক্রান্ত কার্যাবলিতে একটি অনবদ্য আবিষ্কার। একে ভিত্তি করে অন্য সবকিছু প্রতিষ্ঠিত।” (In economics in the whole commercial side of man, social existence, money is the essential invention on which all the rest in based.)
আশাকরি, আপনারা মুদ্রা কি বা কাকে বলে এবং আধুনিক অর্থনীতিতে অর্থের গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানলাভ করতে পেরেছেন। লেখাটি থেকে উপকৃত হলে অন্যদের সাথেও শেয়ার করুন।