ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব সমালোচনা
ম্যালথাসবাদ-এর জনসংখ্যা তত্ত্বটি এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী তত্ত্ব হলেও পরবর্তীকালে তা নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিচে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব সমালোচনা গুলো তুলে ধরা হলো-
১. জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ে না
ম্যালথাসের মতে জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের ভোগ-বিলাস, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তথা জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যায়। বর্তমানে অনেক উন্নত দেশেই লোকসংখ্যা ক্রমহ্রাসমান হারে বাড়ছে।
২. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চাষাবাদ
জমিতে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধির কার্যকারিতার উপর ভিত্তি করে ম্যালথাস ব্যক্ত করেন যে, খাদ্য উৎপাদন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। বাস্তবে জৈব রাসায়নিক সার ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, উন্নত প্রথায় চাষ, উন্নত বীজ, সেচ, পানি নিষ্কাশন ইত্যাদি দ্বারা একই জমিতে খাদ্য উৎপাদন কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এর ফলে খাদ্য উৎপাদনের গাণিতিক হার ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
৩. শিল্প বিপ্লব ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন
ব্রিটেনে সংঘটিত শিল্প বিপ্লব এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে উন্নত দেশগুলোতে উৎপাদনের পরিমাণ জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে। এরূপ প্রযুক্তিগত বিপ্লবের যাদুকরী প্রভাব সম্পর্কে ম্যালথাস মোটেও অবহিত ছিলেন না।
৪. জনসংখ্যার গুণগত দিক উপেক্ষিত
ম্যালথাসের তত্ত্বে জনসংখ্যার কেবল সংখ্যাগত দিকটি বিবেচনা করা হয়েছে, গুণগত দিক উপেক্ষিত হয়েছে। মানুষ শুধু ক্ষুধার্ত মুখ ও পেট নিয়েই জন্মগ্রহণ করে না, কর্মঠ হাত ও বিদ্যা বুদ্ধির সাহায্যে যথেষ্ট উপার্জনের পথও প্রশস্ত করে।
৫. সম্পদের ন্যায্য বন্টন
বর্তমানকালে সম্পদ বণ্টনের সমস্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা হতেও প্রবলতর। সেলিগম্যানের মতে, “জনসংখ্যা শুধু সংখ্যাগত সমস্যা নয় বরং এটি সম্পদের দক্ষ উৎপাদন ও ন্যায্য বণ্টনেরও সমস্যা।” (The problem of population is not one of mere size, but of efficient production and equitable distribution.)
৬. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সহযোগিতা
আংশিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কোনো দেশকে খাদ্য ঘাটতির এলাকা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সহযোগিতার মাধ্যমে পৃথিবীর খাদ্য উদ্বৃত্ত এলাকা হতে খাদ্য ঘাটতি এলাকায় তা সরবরাহ করা সম্ভব।
৭. চিত্তবিনোদন ও উন্নত শিক্ষার কারণে জন্মহার হ্রাস
শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে দেশ উন্নত হলে এবং চিত্তবিনোদনের সুযোগ ও জীবনকে উপভোগ করার বাসনা প্রভৃতির ফলে জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধির কোনো সুযোগ থাকে না।
T. R. Malthus বহু বিতর্কিত, বহু প্রশংসিত নাম। তাঁকে কখনো আমরা হিমালয়ের চূড়ায় তুলেছি, আবার কখনো টেনে নামিয়েছি অতি সাধারণ স্তরে। তবে খুব একটা দূরে বেশি দিন তাঁকে সরিয়ে রাখতে পারিনি। ম্যালথাসের তত্ত্বের অনেক সমালোচনা থাকলেও এ তত্ত্বের গুরুত্ব বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে বিদ্যমান। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের ফলে উন্নত দেশে তাঁর তত্ত্ব ব্যর্থ হলেও দরিদ্র দেশগুলোকে জনসংখ্যার পরিমাণ সম্পর্কে সচেতন করছে এবং খাদ্য ও প্রচলিত শক্তির উৎস যে সসীম সে সম্বন্ধে আমাদেরকে সজাগ করছে। অর্থনীতিবিদ P.A. Samuelson যথার্থই বলেন, “… ভারত, চীন এবং পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে খাদ্য ও জনসংখ্যার মধ্যে সামঞ্জস্যের কথাটি যখন ভাবা হয়, তখন এ তত্ত্বের মধ্যে সত্যের যে বীজ নিহিত আছে, তা প্রমাণিত হয়।” ম্যালথাসের সমালোচকেরা তাঁকে ‘মিথ্যা ভবিষ্যৎ বক্তা’ (False Prophet) বলে অভিহিত করলেও, বাংলাদেশের মতো
দেশগুলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং বিকল্প খাদ্য ও শক্তির উৎস সন্ধানে প্রত্যক্ষভাবে তাঁর কাছে ঋণী। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের চরম সংকট, উচ্চমূল্য, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে, এ তত্ত্ব ভবিষ্যতের জন্য আমাদেরকে সচেতন করবে নিশ্চিত বলা যায়। সুতরাং অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে তাঁর তত্ত্বের প্রয়োগশীলতা লক্ষ্য করা যায়। দু শত বছর পরে উন্নত দেশসমূহেও এ তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নতুন করে গবেষণার ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে।
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব চিত্রসহ ব্যাখ্যা কর |
আমদানি বিকল্প শিল্প কি? বাংলাদেশে আমদানি বিকল্প শিল্পের গুরুত্ব |