সংস্কৃতি কি?
সংস্কৃতির ইংরেজি Culture শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে Latin শব্দ ‘Colere’ থেকে। এর অর্থ হলো কর্ষণ বা চাষ। সুতরাং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্কৃতি বলতে বুঝায় কর্ষণের মাধ্যমে কিংবা সংস্কারের মাধ্যমে বা মার্জনার মাধ্যমে প্রাপ্ত বিষয়।
গোড়াপত্তন: ষোড়শ শতকের শেষদিকে ইংরেজ মনীষী ফ্রান্সিস বেকন সর্বপ্রথম ইংরেজি সাহিত্যে Culture শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে W. Emerson আমেরিকায় একে পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ ও সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস চালান। যদিও যে অর্থে তিনি সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করেন, পরবর্তীতে অন্যান্য তাত্ত্বিকদের কাছে সেভাবে তা প্রতিভাত হয় নি।
আরও পড়ুন: সামাজিক মূল্যবোধ বলতে কি বুঝায়?
সংস্কৃতির সংজ্ঞা
সংস্কৃতির বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। নিম্নে সংস্কৃতির কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো-
সংকীর্ণ অর্থে : সংকীর্ণ অর্থে সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি মার্জিত রুচি বা অভ্যাসজনিত উৎকর্ষ।
ব্যাপক অর্থে : ব্যাপক অর্থে জীবনযাত্রার প্রণালী বা জীবনধারাকেই সংস্কৃতি বলা হয়।
জোন্স (Jones) তাঁর ‘Basic Principles of Sociology’ গ্রন্থে সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, “Culture is the sum of man’s creations.” অর্থাৎ, মানবসৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টিই হলো সংস্কৃতি।
কুলি, এঞ্জেল এবং কার (Cooley, Angel and Carr) এর মতে, “Culture is the sum total of transmittable result of living together.” অর্থাৎ, একত্রে বাস করার ফলশ্রুতি যা বংশ পরম্পরায় বাহিত হয় তাই সংস্কৃতি।
ম্যালিনোস্কি (Malinowski) এর ভাষায়, “Culture is the handiwork of man and the medium through which he achieves his end.” অর্থাৎ, সংস্কৃতি হলো মানুষের তৈরি বস্তু ও একটি উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য সাধন করে।
ইংরেজ সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer) তাঁর ‘Principle of Sociology’ নামক গ্রন্থে সংস্কৃতিকে Super Organic অর্থাৎ জৈবিক ও অজৈবিক বা জীবজগৎ ও জড় জগতের ঊর্ধ্বে এমন একটি উন্নততর পরিবেশ বলে ধারণা করেছেন, যে পরিবেশ কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়।
‘Encyclopaedia of Social Science’ অনুসারে, “সংস্কৃতি মানুষের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ব্যবহারিক শিল্প দ্রব্যসামগ্রী, কারিগরি প্রণালী, ধারাসমূহ, অভ্যাস ও মূল্যবোধ।”
ম্যাকাইভার (MacIver) এর মতে, “Culture is what we are.” অর্থাৎ, আমরা যা তাই আমাদের সংস্কৃতি।
বস্তুগত সংস্কৃতির চেয়ে অবস্তুগত সংস্কৃতিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া সত্ত্বেও E. B. Tylor এর সংস্কৃতি সংক্রান্ত উক্তিটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী তাঁর ‘Primitive Culture’ গ্রন্থে বলেন, “Culture is that complex whole which includes knowledge, belief, art, morals, law, custom and any other capabilities and habits acquired by man as a member of society.” অর্থাৎ, সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত আচার-আচরণ, ব্যবহার, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, প্রথা, আইন ইত্যাদির জটিল সমন্বয়ই হলো সংস্কৃতি।
অর্থাৎ, সমাজ বা Society দুইটা কাঠামোর ওপর গঠিত। যথা-
Basic Structure (মৌল কাঠামো), ও
Super Structure (উপরি কাঠামো)।
কার্ল মার্কস (Karl Marx) এর মতে, “Culture is super structure.” অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো উপরি কাঠামো। Marx এর মতে, Basic Structure বা মৌল কাঠামো সমাজের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া তথা Base বা Foundation কে চিহ্নিত করে। অন্যদিকে, Super Structure হচ্ছে Base এর উপর ক্রিয়াশীল অর্থনৈতিক উপাদান ব্যতীত ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক সকল উপাদান, আইনকানুন, দর্শন, রাজনীতি, চিন্ত চেতনা, আদর্শ ও মূল্যবোধ এবং শিল্পকলা ইত্যাদি।
উপরে সংস্কৃতি সম্পর্কে যেসব সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সেই আলোকে বলা যায়, সমাজ আকাঙ্ক্ষিত ধারায় জীবনযাপন করতে গিয়ে মানুষ যা সৃষ্টি করে বা আয়ত্ত করে = সেসবের সামগ্রিকতাই সংস্কৃতি। এভাবেই মানব সংস্কৃতি সামাজিক উত্তরাধিকারের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বা এক যুগ থেকে অন্য যুগে প্রবাহিত হয়।